রূপচর্চা ও পুষ্টিগুণে মধুর আভিজাত্য শুনে কি অবাক লাগছে? তাহলে শুনুন মধুর উৎপত্তি সম্বন্ধে কিছু কথা। কোন পতঙ্গের উৎপাদিত পদার্থকে যদি ভীষণ উপকারী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, আপনি কি তা স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করবেন? এই প্রশ্ন শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন যে, আমি তো জীবনেই এমন কিছু গ্রহণ করতাম না। অথচ আপনিও কিন্তু কখনো না কখনো এর স্বাদ নিয়েছেন ঠিকই! বলছিলাম মধুর কথা। যে মধু কেবল খাদ্য নয়, বরং একে ঔষধি উপাদান বললেও ভুল হবে না!
বহু গুণে গুণান্বিত মধু মূলত তৈরি হয় মৌমাছি দ্বারা। মধু তৈরির জন্য মৌমাছি ফুলের রস বা নেক্টার ব্যবহার করে। ফুলের মধু ও রেনু সংগ্রহ করতে মৌমাছি ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় আর হুল দিয়ে রস সংগ্রহ করে তা মধু পাকস্থলিতে জমা করে। মধু পাকস্থলি পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর মৌমাছি তা মৌচাকের অন্য মৌমাছিদের কাছে স্থানান্তরিত করে। অন্যান্য মৌমাছিরা সেই রস অনেকটা সময় ধরে প্রক্রিয়াজাত করে এরপর জমা করে মোম বেষ্টিত কোষের তলায়। পাশাপাশি মৌমাছিরা ডানা ঝাপটানোর মাধ্যমে চাকে বায়ু চলাচল অব্যাহত রাখে ফলে বাষ্পীকরণ চলমান থাকে। আস্তে আস্তে ফুলের রস বা পুস্পাসবের জলীয় অংশ যখন ১৫-২০% এ এসে ঠেকে তখন মধু পরিপক্ক হিসেবে ধরা হয় এবং মৌমাছিরা প্রকোষ্ঠটিকে মোমের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়।
এ তো গেলো মধু প্রস্তুতির প্রক্রিয়া। কিন্তু আপনারা কি জানেন, মধুতে এমন কোন কোন উপাদান আছে যা আমাদের শরীরের জন্য এতটা উপকারী?
মধুতে রয়েছে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫ থেকে ১২ শতাংশ মল্টোজ। আরও থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ শতাংশ এনজাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। তাছাড়া ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ শতাংশ ক্যালরি।
এ তো গেলো মধুতে থাকা সব পুষ্টিকর উপাদান। এখন চলুন জেনে নেয়া যাক মধুর কিছু উপকারিতা যার জন্য মধু কেবল খাদ্য নয় বলে অভিহিত করা যায়।
১। শক্তির উৎসঃ মধু ভালো শক্তি প্রদানকারী খাদ্য। তাপ ও শক্তির অন্যতম সেরা উৎস। মধু দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে।
২। হজমে সহায়তাঃ মধুতে যে শর্করা থাকে, তা সহজেই হজম হয়। কারণ, এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে, তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করা শুরু করে। যারা প্রায়শই পেটের অসুখে ভোগেন তাদের জন্য মধু বিশেষ উপকারী।
৩। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করেঃ মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। এটি ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ১ চা–চামচ খাঁটি মধু ভোরবেলা পান করলে কোষ্ঠবদ্ধতা এবং অম্লত্ব দূর হয়।
৪। রক্তশূন্যতায়ঃ মধু রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা করে বলে এটি রক্তশূন্যতায় বেশ ফলদায়ক। কারণ, এতে থাকে খুব বেশি পরিমাণে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ। এই উপাদানগুলো রক্তশূন্যতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৫। ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়েঃ বলা হয়, ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু বিশেষ উপকারী। যদি একজন শ্বাসকষ্ট রোগীর নাকের কাছে মধু ধরে শ্বাস টেনে নেওয়া হয়, তাহলে সে স্বাভাবিক এবং গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিতে পারবে। আবার অনেকে মনে করে, এক বছরের পুরোনো মধু শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বেশ ভালো।
৬। অনিদ্রায়ঃ মধু অনিদ্রার খুব ভালো ওষুধ। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুই চা–চামচ মধু মিশিয়ে খেলে এটি গভীর ঘুম ও সম্মোহনের কাজ করে।
৭। প্রশান্তিদায়ক পানীয়ঃ হালকা গরম দুধের সঙ্গে মিশ্রিত মধু একটি প্রশান্তিদায়ক পানীয়। এই পানীয় মস্তিষ্ককে শান্ত করে।
৮। মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায়ঃ মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায় মধু ব্যবহৃত হয়। এটা দাঁতের ওপর ব্যবহার করলে দাঁতের ক্ষয়রোধে সাহায্য করে। দাঁতে পাথর জমাট বাঁধা রোধ করে এবং দাঁত পড়ে যাওয়াকে বিলম্বিত করে। মধু রক্তনালিকে সম্প্রসারিত করে দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষা করে। যদি মুখের ঘায়ের জন্য গর্ত হয়, এটি সেই গর্ত ভরাট করতে সাহায্য করে এবং সেখানে পুঁজ জমতে দেয় না। মধু মিশ্রিত পানি দিয়ে গড়গড়া করলে মাড়ির প্রদাহ দূর হয়।
৯। পাকস্থলীর সুস্থতায়ঃ মধু পাকস্থলীর কাজকে জোরালো করে এবং হজমের সমস্যা দূর করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের ক্ষরণ কমিয়ে দেয় ফলে অরুচি, বমিভাব, বুকজ্বালা এগুলো দূর করা সম্ভব হয়।
১০। তাপ উৎপাদনেঃ শীতের ঠান্ডায় এটি শরীরকে গরম রাখে। এক অথবা দুই চা–চামচ মধু এক কাপ ফুটানো পানির সঙ্গে খেলে শরীর ঝরঝরে ও তাজা থাকে।
১১। পানিশূন্যতায়ঃ ডায়রিয়া হলে এক লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার মধু মিশিয়ে খেলে দেহে পানিশূন্যতা রোধ করা যায়।
১২। দৃষ্টিশক্তি বাড়াতেঃ মধু চোখের জন্য অত্যন্ত ভালো। গাজরের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।
১৩। ওজন কমাতেঃ মধুতে নেই কোনো চর্বি। মধু পেট পরিষ্কার করে, চর্বি কমায়। যার ফলে ওজন কমতে সহায়তা করে মধু।
১৪। হজমে সহায়তাঃ মধু প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি। তাই মধু সহজে হজম হয় এবং হজমে সহায়তা করে।
১৫। গলার স্বরঃ অবাক হলেও সত্য যে মধু গলার স্বর সুন্দর ও শ্রুতিমধুর করতে মধুর ভূমিকা অনবদ্য।
১৬। তারুণ্য বজায় রাখতেঃ তারুণ্য বজায় রাখতে মধুর ভূমিকা অপরিহার্য। এটি অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় ত্বকের রং ও ত্বক সুন্দর করে। ত্বকের ভাঁজ পড়া ও বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। শরীরের সামগ্রিক শক্তি ও তারুণ্য বাড়ায়।
১৭। হাড় ও দাঁত গঠনেঃ মধুর গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম দাঁত, হাড়, চুলের গোড়া শক্ত রাখার পাশাপাশি নখের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে, ভঙ্গুরতা রোধ করে।
১৮। আমাশয় ও পেটের পীড়া নিরাময়েঃ পুরোনো আমাশয় এবং পেটের পীড়া নিরাময়সহ নানাবিধ জটিল রোগের উপকার করে থাকে খাঁটি মধু।
১৯। উচ্চ রক্তচাপ কমায়ঃ প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুইবার দুই চামচ মধুর সঙ্গে এক চামচ রসুনের রস প্রতিদিন খেলে উচ্চ রক্তচাপ কমায়। প্রতিদিন সকালে খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে খাওয়া উচিত।
২০। রক্ত পরিষ্কারকঃ এক গ্লাস গরম পানির সঙ্গে এক বা দুই চামচ মধু ও এক চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খান। এটা রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। তা ছাড়া রক্তনালিগুলোও পরিষ্কার করে।
২১। রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায়ঃ মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায় এবং শরীরের ভেতরে এবং বাইরে যেকোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতাও জোগান দেয়। মধুতে আছে একধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধকারী উপাদান, যা অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে।
এই তো গেল স্বাস্থ্য উপকারিতা। এছাড়াও রূপচর্চায় মধু কিন্তু বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে সেই আদিকাল থেকে। আর্দ্রতা কম হলেও মধু প্রাকৃতিকভাবে ত্বককে আর্দ্র করে। শরীরের যেখানে চামড়া শুকিয়ে গেছে বা ফেটে গেছে এমন জায়গাটি আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিয়ে, এক চা চামচ পরিমাণ মধু সেইখানে লাগিয়ে তা ২০ মিনিটের মধ্যে ধুয়ে ফেললে দেখা যায় ত্বকের অবস্থা আগের থেকে ভালো হয়ে এসেছে। তাছাড়া ফাটা ঠোঁটে মধু লাগিয়ে দেখতে পারেন। চেটে খেয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকতে পারলে দ্রুতই ঠিক হবে এই সমস্যা।
দেহের বাহ্যিক দিকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে মধুর অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল উপকারিতার ব্যাপারে অনেকেই জানেন। এছাড়াও বাসায় নিজেই যখন মধুর মাস্ক বানিয়ে ব্যবহার করতে পারছেন, তখন আর মধু মেশানো প্রসাধনী সামগ্রী কিনে কী হবে?
আরও অবাক করা একটি বিষয় হচ্ছে মধু লাইপোমা গলিয়ে ফেলতে সক্ষম। লাইপোমা এক ধরনের টিউমার যা ত্বকের নিচে হয়৷ কয়েক বছর ধরে বেড়ে চলা লাইপোমাতে কয়েক মাস নিয়মিত মধু লাগালে এটি আকারের ভিত্তিতে ১ থেকে ৩-৪ মাসের মধ্যে গলে হারিয়ে যায়। বিভিন্ন ভেষজ গুল্ম ও অন্যান্য থেরাপির পাশাপাশি মধুর ব্যবহার লাইপোমা দূর করার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে। এর ফলে বেঁচে যাওয়া যায় সার্জারির সম্ভাবনা থেকেও।
রূপচর্চা ও পুষ্টিগুণে মধুর আভিজাত্য এই মধু আবার চুলের যত্নেও বেশ উপকারী। আপনি গোসলে যে পরিমাণ শ্যাম্পু ব্যবহার করেন, তাতে এক চা চামচ মধু মেশান। পেয়ে যাবেন একটি পুষ্টিকর শ্যাম্পু। এটি ভঙ্গুর ও রোগাক্রান্ত চুল সুস্থ করে খুব দ্রুত। নিয়মিত ব্যবহারে ফলাফল দেখতে পাবেন নিজেই। পাশাপাশি খুশকি দূর করতেও এটি চমৎকার কাজ করে।
আবার প্রতিদিন বাইরে ঘুরে বেরানোর ফলে ত্বকের সানবার্ন থেকে মুক্তি দেয় এই মধু। ত্বকের গভীরতম স্তর পর্যন্ত আর্দ্র করে মধু দ্রুততর উপশম নিশ্চিত করে। এর আরামদায়ক ও অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি প্রভাব আছে বলেই তা ত্বকের যত্নে এতো উপকারী হয়ে উঠে।
অনেকের ঠান্ডার ধাঁচ থাকে। ফলে ফ্লুতে আক্রান্তের ঝোঁকও বেশি থাকে। তারা কেবল লেবুর শরবতে এক চামচ মধু মিশিয়ে পান করলে ঠাণ্ডা ও ফ্লুয়ের ক্ষেত্রে বেশ উপকার পায়। আবার যারা নিয়মিত দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যায় তারা নিয়মিত মধু সেবনের অভ্যাস করতে পারলে বেশ উপকার হয়।
রূপচর্চা ও পুষ্টিগুণে মধুর আভিজাত্য আরও জানুন। ঔষধি ও রূপচর্চায় মধুর ব্যবহারের পাশাপাশি প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ হিসেবেও মধু দারুণ কাজ করে। তাইতো মমি বানাতেও ব্যবহার করা হতো এই খাঁটি মধু। ডাঃ স্টয়মির ম্ল্যাডেনভ তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, তিনি প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম মধু দিয়ে যকৃত, ডিম, ছোট প্রাণী সংরক্ষণ করার পরীক্ষা করেছেন। তাছাড়াও রূপচর্চায় বহু বছর ধরেই মধুর ব্যবহার বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয়।
মধু মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এক অপূর্ব নেয়ামত। স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং যাবতীয় রোগ নিরাময়ে মধুর গুণ অপরিসীম। তাইতো মধু কেবল খাদ্য নয় বলেই বিশ্বাসী মধু নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলা প্রতিটি ব্যক্তি।
তবে মধুর এতশত উপকারিতা পাওয়ার জন্য আপনার মধু হওয়া চাই শতভাগ খাঁটি। কেননা খাঁটি মধু ব্যতীত উপকার তো আসবেই না বরং কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতি সাধনের ঝুঁকিও থেকে যায়। কিন্তু এই খাঁটি মধুর প্রাপ্তিস্থান নিয়ে অনেকেই থাকেন শঙ্কাগ্রস্থ। যারা এমন সঙ্কটে আছেন তাদের পাশে আছে খাস ফুড। নিশ্চিন্তে খাঁটি মধু সংগ্রহ করতে চাইলে আপনাদের জন্য খাস ফুডের দরজা সব সময় উন্মুক্ত।