“নববর্ষের আমেজ যেতে না যেতেই কালবৈশাখীর ঝড়ে চারদিকে তাণ্ডব শুরু হতো। তুমুল ঝড়ের পর ধরণী যখন একটু শান্ত তখন এক ঝাঁক কিশোর কিশোরী দুরন্তপনায় মেতে উঠতো ঝড়ে পড়া আম কুড়োতে। সেই আলো – আঁধারিতে আম কুড়োনোর মজাই আলাদা! সেই কিশোর কিশোরীর দলে আমিও ছিলাম, জানিস তো মা!”
এভাবেই মেয়ের সাথে গল্প করতে গিয়ে শৈশবের স্মৃতিচারণ করছিলেন হাসনাত সাহেব। আমের শহর সাতক্ষীরায় বেড়ে উঠায় গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহেও প্রশান্তি লুকিয়ে ছিলো যেনো। ছেলেবেলায় হয়তো ভাবনাতেও আসেনি যে একসময় এই সুস্বাদু রসালো আম খাওয়া তো দূর, ভালোমানের আমের জন্যও হিমশিম খেতে হবে!
আমের শহর হিসেবে রাজশাহী কে পরিচয় না করিয়ে সাতক্ষীরার কথা বলায় অনেকের মনেই হয়তো একটু দ্বিধা উঁকি দিয়েছে৷
আমরা হরেক রকম আমের সাথে পরিচিত হলেও একবার যে হিমসাগর আম এর স্বাদ নিয়েছে সে নিশ্চয়ই বুঝেছেন কেনো সাতক্ষীরার কথা বলা হয়েছে! আমরা সকলেই জানি আম কে ফলের রাজা বলা হয়। তবে এই আমেরও একটি রাজা আছে আর তা হচ্ছে হিমসাগর। হলুদ কমলা রঙের আঁশহীন রসালো হিমসাগর আমের সুখ্যাতি রয়েছে দেশ ব্যাপী।
এই আমের ইতিহাস ঘাটতে গেলে দেখা যায় এর নরম রসাল শাঁস, সুমিষ্ট ঘ্রাণ এবং আঁশহীন হওয়ায় একে আমের রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রাজশাহীতে এই আম স্বল্পসংখ্যক উৎপাদিত হলেও এর মূল ফলন দেখা যায় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং ভারতের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ জেলায়। হিমসাগর আমের গাছ থেকে ফলন পেতে হলে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে ১২ বছর! অর্থাৎ, এই আমের গাছ ১২ বছর বয়সী হলে এরপর থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে ফলন শুরু হয়। এই আম জুনের শুরুতে পাকতে শুরু করে এবং পুরো জুন মাস জুড়েই এর সমারোহ দেখা যায়।
মাঝারি গড়নের প্রায় ২২০ গ্রাম ওজনের এ আমের সাথে অনেকেই ক্ষীরসাপাত আম কে গুলিয়ে ফেলেন। আবার অনেক জায়গায় ক্ষীরসাপাত আমকে হিমসাগর বলেও চালিয়ে দেওয়া হয়। তবে আমের উপরিভাগের রঙ দেখে কিন্তু সহজেই পার্থক্য বের করতে পারবেন ক্ষীরসাপাত এবং হিমসাগর আমের মধ্যে।
ক্ষীরসাপাত আম পাকা শুরু করলে এর বহিত্বক এর উপরের অংশ হলুদ রঙ ধারণ করে। অপরদিকে হিমসাগর আম পাকা শুরু করলেও হালকা সবুজাভ রঙ দেখায়। ফলে এই বাহ্যিক পার্থক্য দেখে খুব সহজেই আম এর মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করা সম্ভব।
মসৃণ ত্বক ও পাতলা খোসা বিশিষ্ট এই আম এর মিষ্টতার পরিমাণ শতকরা ৮.৮৪ ভাগ। পরিপক্ক আম গাছ থেকে সংগ্রহের পর সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে প্রায় ৮ দিন পর্যন্ত ভালো ভাবে রাখা যায়। আমের বোটা তুলনামূলক শক্ত হওয়ায় ঝোড়ো পরিবেশেও বেশ ক্ষাপ খাইয়ে নিতে পারে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি একটু কম হয়।
মধ্য মৌসুমি জাতের এই সুস্বাদু আম এখন আম বাগানগুলোতে শোভা পাচ্ছে। শীঘ্রই আম পাকা শুরু হলে তা ছড়িয়ে পড়বে দেশের নানান অঞ্চলে। সকলে আস্বাদন করতে পারবে মধুমাসের এই সুমিষ্ট ফলটি। তবে মিষ্টতার মাত্রা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় ডায়াবেটিস রোগীরা অনেকক্ষেত্রেই এই আম গ্রহণে সংকোচ বোধ করে। আবার আমের স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতেও যেনো মন মানে না! এই জটিল সমস্যার একটি সুন্দর ও সহজ সমাধান হচ্ছে আম গ্রহণ করতে হবে সকালের দিকে। যত বেলা গড়াবে ততই দূরত্ব বাড়াতে হবে আমের সাথে। অর্থাৎ, দুপুরের আগ অবধি আপনি নির্দ্বিধায় আম খেতে পারবেন। কিন্তু যেহেতু ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করা এমনিতেই বেশি থাকে এবং আমেও এর পরিমাণ একটু বেশি তাই পরিমাণে অল্প করে আম খেতে হবে। এক্ষেত্রে একদিন এ হিমসাগর আমের অর্ধেক অংশ খাওয়ার ব্যাপারে পুষ্টিবিদেরা বলে থাকেন। আর সেই সাথে যদি আপনি অন্যান্য খাবার থেকে ক্যালরি গ্রহণ একটু কমিয়ে আনতে পারেন তবে আম খেতে পারবেন নিশ্চিন্তে।
সকল মৌসুমি ফল আল্লাহ তা’আলার এক অশেষ নিয়ামত। শুধু স্বাদেই নয় পুষ্টিমানেও এই ফলগুলো অনন্য। তাই হাইব্রিড এর এই যুগে মৌসুমি ফল গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেষ্ট হওয়া উত্তম। আর সেই সাথে বিশ্বস্ত জায়গা থেকেও ফল কেনা আবশ্যক যেনো ক্ষীরসাপাত আম হিমসাগর বলে কিনে বোকা বনে যেতে না হয়!