ভাত ছাড়া তো আমাদের বাঙালিদের চলেই না! আমাদের প্রধান খাবার বলে কথা! তবে প্রধান খাবার হলেও কিন্তু ভাতের পুষ্টিগুনই সর্বোত্তম নয়। সেজন্যেই অনেককেই ইদানীং ডাক্তারের পরামর্শে ভাত খাওয়া কমিয়ে দিতে হয় কিংবা বাদই দিতে হয়!
কিন্তু একটু খেয়াল করলেই কিন্তু প্রিয় খাবার ভাত খেতে পারবেন, কোনরকম স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াই। কীভাবে?
বিষয়টা তাহলে খুলেই বলি!
আমরা শহরের বাসা বাড়িতে সচরাচর যে কয়েকটি জাতের চাল খেয়ে থাকি বা যাদের সাথে পরিচিত, সেগুলো ছাড়াও কিন্তু চালের আরও বাহারি গুণাগুণ ও স্বাদসম্পন্ন জাত আছে। পৃথিবীতে প্রায় ৪০,০০০ ধরনের ধান বা চাল পাওয়া যায়।
তেমনই একটি বিশেষ প্রকারের চাল হল বিনি চাল!
বিন্নি চাল সাধারণত সাদা, লাল এবং কালোও হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষ হয় সাদা বিন্নী চাল। লাল বিন্নি উৎপাদিত হয় মূলত পাহাড়ি এলাকাতে। জুম চাষের মাধ্যমে স্থানীয় উপজাতিরা বা কৃষকেরা এই ধান উৎপাদন করে থাকেন সিলেট, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি অঞ্চলে। সিলেটে এই চালকে বিরুন চালও বলা হয়ে থাকে। সব অঞ্চলেই নবান্ন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ বিন্নি চালের পিঠা, পায়েস, ফিরনি ইত্যাদি।
‘পহেলা দর্শনধারী’ নীতিতে এই চাল একটু পিছিয়ে গেলেও ‘তারপর গুনবিচারি’তে গেলে এই চালের ধারে কাছে কেউ নেই!
পুষ্টিগুণের দিক থেকে বিন্নি চালের বিশেষত্ব হল এতে অন্য সব চালের তুলনায় ক্যালোরি ও কার্বোহাইড্রেট কম থাকে। এই চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অন্য সব চালের তুলনায় বেশ কম। তাই কিছুটা বেশি খেলেও ডায়াবেটিস বেড়ে যাবার বা মুটিয়ে যাবার ভয় কম।
এছাড়াও বিন্নি চাল অন্য অনেক খাদ্য গুনে ভরপুর। রোগ প্রতিরোধে সেরা বিন্নি চাল ক্যানসাররোধী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যেমন অ্যানথোসায়ানিন বা ফ্ল্যাভেনয়েডে পরিপূর্ণ। মূলত এই ক্যান্সার প্রতিরোধক অনেক বেশি পরিমাণে ধারণ করার কারণেই এর রংটা অন্য চালের তুলনায় গাঢ় হয়ে থাকে।
এই চালে শর্করা কম, কিন্তু আঁশ ও ভিটামিন-বি এর পরিমাণ অনেক বেশি। এছাড়াও বিন্নি চাল ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, সেলেনিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন খনিজ লবণে ভরপুর। ফলে এই চাল নিয়মিত খেলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ধমনিতে রক্ত জমাট বাঁধা কিংবা হজমে গোলমাল সহজেই নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়াও ত্বক, চুল ও হাড় মজবুত করতে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এই চালের জুড়ি নেই।
জুম পদ্ধতিতে চাষ করা হয় বলে পাহাড়ি উর্বর মাটির অনেকটা পুষ্টিগুণ এই চালে রয়ে যায়। আর তাছাড়া অন্য ধানের মত বিন্নি ধানকে সেদ্ধ করে নিতে হয়না বলে এক্ষেত্রেও পুষ্টিগুণ থাকে অটুট।
এবার আসি এর স্বাদগত বিশেষত্বে!
সুন্দর রং ও সুঘ্রাণসমৃদ্ধ এই চাল রানার পর অনেক বেশি আঠালো হয়ে যায়। এজন্যেই একে ইংরেজিতে বলে Sticky Rice। কিন্তু এই আঠালো চাল দিয়েই আমাদের গ্রামবাংলার নারীরা তৈরি করতেন মুখরোচক সব পিঠা, পায়েস ও খিচুড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার মধুভাত তৈরিতে ব্যবহার হয় এই আঠালো বিন্নি চাল।
চীনে কালো বিন্নি চালের ইতিহাস অনেক পুরানো। চৌদ্দ শতক থেকেই চীনে এই চালের চাষ হত। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সেইসময় রাজা বা রাজ পরিবার ছাড়া আর কারোই সেই চালের ভাত খাবার অধিকার ছিল না। প্রজাদের জন্য এই চাল নিষিদ্ধ ছিল। তাই এখনো চীনে এই চাল Forbidden Rice বা নিষিদ্ধ চাল নামেই পরিচিত।
আমাদের দেশে আদিবাসীদের কাছেও এই চাল বিলাসী খাদ্য বা দামী চাল হিসেবে পরিচিত। উৎসবে, অনুষ্ঠানে বিন্নি চাল তাদের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিন্নি ধান ছাড়া তাদের সমাজে কোনো বিয়ের প্রস্তাব গৃহীত হয় না। চাকমা ও মারমারা এই চালকে ‘পোড়া বিন্নি’ নামে চেনে।
যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যস্ত পৃথিবী আরও ব্যস্ততর হচ্ছে, সেই সাথে বাড়ছে আমাদের জ্ঞানের পরিধি। আদি বাংলার ঐতিহ্যবাহী ধান সম্পর্কে জানার পর তাই আমাদের চেষ্টা করতে হবে যেন শুধুমাত্র জসীম উদদীন এর গ্রাম্য কবিতাই বিন্নি চালের শেষ আশ্রয় না হয়। এই বিখ্যাত বিন্নি চাল যেন বাংলার ঘরে ঘরে রয়ে যায় এর বিশেষ স্বাদ ও গুণাগুণ নিয়ে।