খাদ্যের গুনাগুণ

চিয়া সিড এর উপকারিতা, অপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম | Khaas Food

কালচে ধূসর বর্ণের মধ্যে সাদা-কালোর ছোপ ছোপ মিশেলের ছোট্ট একটি বীজ, যা আপনার স্বাস্থ্যকে আমূল বদলে দিতে পারে। বলছিলাম চিয়া সিড (Chia Seed) এর কথা। দেখতে ছোট হলেও এই বীজটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং একে বলা হয় প্রকৃতির “সুপারফুড“। আজকের দিনে, স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের খাদ্যতালিকায় এটি একটি অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে। চলুন, চিয়া সিডের জাদুকরী গুণাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানি! 

চিয়া সিড – অতীত থেকে বর্তমানে

চিয়া সিড (Salvia hispanica) মূলত প্রাক-কলম্বিয়ার যুগে অ্যাজটেকদের দ্বারা চাষ হত এবং মেসোয়ামেরিকান সংস্কৃতিগুলির প্রধান খাদ্য ছিল। এছাড়া ইতিহাস  হাতড়ে জানা যায় এই বীজ প্রাচীন মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতায় এটি শক্তি ও সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

এই বীজ মিন্ট বা পুদিনা পরিবারের একধরনের ফুলের বীজ। এই বীজ হাইগ্রোস্কোপিক বা তরল শোষক অর্থাৎ কোন তরলের সাথে মেশানো হলে তা সেই তরল বা পানীয়কে শোষণ করে থকথকে জেলিভাব প্রদান করে। চিয়া সিড নিজের ওজনের চেয়ে ১২ গুণ বেশি তরল পদার্থ শোষণ করতে পারে। 

অতীতে যদিও প্রধান খাদ্য হিসেবে চাষ হতো কিন্তু বর্তমানে বানিজ্যিক ভিত্তিতে মেক্সিকো ও গুয়েতেমালার পাশাপাশি বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যে চাষ হচ্ছে। আর এর চমৎকার পুষ্টিমানের জন্য এর চাহিদাও উত্তোরত্তর বাড়ছে।

চিয়া সিড খাওয়ার উপকারিতা

USDA অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া সিড থেকে ৪৮৬ ক্যালরি পাওয়া যায়। এছাড়া সোডিয়াম ১৬ মি গ্রা, পটাশিয়াম ৪০৭ মি গ্রা, ডায়েটারি ফাইবার বা খাদ্য আঁশ পাওয়া যায় ৩৪ গ্রাম। একই সাথে ফসফরাস, কপার, সেলেনিয়ামের মতন ট্রেস মিনারেলেরও এক চমৎকার উৎস এই বীজ। এছাড়াও এতে রয়েছে ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সহ ভিটামিন ও মিনারেল। চিয়া সিডের পুষ্টিগুণের ব্যাপারে তো জানা গেলো, এবার নজর দেওয়া যাক এর স্বাস্থ্য উপকারিতার দিকে।

১। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে

চিয়া সিডে উপস্থিত ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমায়, হৃদকম্পন স্বাভাবিক রেখে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখে। একই সাথে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিহত করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। 

২। রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে

চিয়া সিডে বিদ্যমান ফাইবার মূলত অদ্রবনীয় খাদ্য আঁশ এবং মিউসিলেজ প্রকৃতির। এই ফাইবার রক্তের শর্করার মাত্রা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ধীর গতি সম্পন্ন করে তোলে ফলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। 

৩। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়

The Nurse’s Health Study এর এক গবেষণায় দেখা যায় যারা আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিড অধিক পরিমাণে গ্রহণ করে তাদের ৪০ শতাংশের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস পায়। এছাড়াও ৬৫ বছর বয়স বা তার উর্ধ্বের ৫০০০ হাজার জন পুরুষ ও মহিলার উপর করা অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায় যারা আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিড গ্রহণ করে তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের এস্কেমিক হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি হ্রাস পায়। 

৪। প্রদাহ হ্রাস করে

চিয়া সিডে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড দেহের প্রদাহ হ্রাস করে। যার ফলে ক্যান্সারের মত প্রাণঘাতী অসুখের বিরুদ্ধেও দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। 

৫। ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে

চিয়া সিডে ফাইবার থাকায় তা পরিতৃপ্তি দেয়। ফলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে যা ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। 

চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম

চিয়া সিড সবসময়ই পানি বা কোন তরলে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ রেখে এরপর গ্রহণ করা উচিৎ। কেননা হাইগ্রোস্কোপিক বা তরল শোষক জাতীয় হওয়ায় শুকনো চিয়া সিড গ্রহণ করলে তা মুখের লালার সাথে মিশে খানিকটা ভিজে যাওয়ায় গিলতে গিয়ে  গলায় আটকে যেতে পারে বা শ্বাসতন্ত্রে গোলযোগ ঘটতে পারে। 

পানি বা অন্য তরল পদার্থে ভিজিয়ে রাখা চিয়া সিড বিভিন্ন ফলের সাথে মিলিয়ে ফ্রুট কাস্টার্ড, ফ্রুট সালাদ বা স্মুদি তে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়েও গ্রহণ করা যায়৷ তবে সকালে খালি পেটে  গ্রহণ করলে কিছুটা সময় ক্ষিদা নিবৃত্ত করে যা ওজন নিয়ন্ত্রণে খানিকটা ভূমিকা রাখে। 

চিয়া সিড খাওয়ার অপকারিতা

চিয়া সিডের অনেক উপকারিতা থাকা স্বত্ত্বেও এর কিছু অপকারী দিকও রয়েছে। এক নজরে সেগুলো জেনে নেওয়া যাক – 

  • যদিও কোষ্ঠ্যকাঠিন্যের মত সমস্যায় চিয়া সিড উপকারী তবে অতিমাত্রায় গ্রহণ করলে চিয়া সিডই পেট ফাঁপা, অ্যাসিডিটি বা কোষ্ঠ্যকাঠিন্যের মত সমস্যার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। 
  • যেহেতু চিয়া সিড রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক সেক্ষত্রে ব্যক্তিভেদে চিয়া সিড ব্লাড থিনার বা রক্ত পাতলাকারক ঔষধের সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। 
  • ঠিকমতো ভিজিয়ে গ্রহণ না করলে চিয়া সিড গলায় আটকে গিয়ে শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যার সূত্রপাত ঘটাতে সক্ষম। 

মাত্রাতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়, একই কথা প্রযোজ্য চিয়া সিডের ক্ষেত্রেও। তাই অধিক স্বাস্থ্য উপকারী খাবার বিবেচনায় মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণ না করে দিনে ১-২ চা চামচের বেশি গ্রহণ না করাই উত্তম। 

চিয়া সিড নিঃসন্দেহে বেশ উপকারী খাদ্য উপাদান। এর পুষ্টি মান ও গুণাগুণ সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে অবশ্যই ঢালাওভাবে গ্রহণ না করে একজন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন এবং চিয়া সিড কোথা থেকে কিনছেন তা খেয়াল করে কিনুন। কেননা ভেজালের মিশ্রণে এই উপকারী খাবারটিও হয়ে উঠতে পারে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। 

Leave a Reply