আনোয়ার সাহেব এশার নামায শেষ করেই নওরিনের কাছে গেলেন। নওরিন ঘুমুচ্ছে। নওরিন আনোয়ার সাহেবের একমাত্র মেয়ে। গত তিনদিন ধরে মেয়েটা অসুস্থ। স্কুলের সামনে বিক্রি করা এটা সেটা খেয়ে নওরিনের অসুস্থতা!
ডাক্তার বলেছেন – বাইরের খাবার না খেতে এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে। আনোয়ার সাহেব খুবই চিন্তিত। উনার মেয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে। প্রতিটা বাবা মা’ই তাই থাকেন। সন্তানের ভালো-মন্দ নিয়ে বাবা মায়েরা সবসময়ই উদ্বিগ্ন থাকেন।
কিন্তু আনোয়ার সাহেব চিন্তিত কারন, এখন প্রতিযোগিতার এই বাজারে পুষ্টিকর খাবারেও মেশানো হয় ভেজাল। যেকোন ভেজাল খাবার মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত করতে পারে।
কিন্তু আনোয়ার সাহেব চিন্তিত কারন, এখন প্রতিযোগিতার এই বাজারে পুষ্টিকর খাবারেও মেশানো হয় ভেজাল। যেকোন ভেজাল খাবার মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত করতে পারে।
নওরিনের মুখের দিকে তাকাতেই কেঁদে ফেললেন তিনি। এমন সময় কাঁধে হাত রেখে উনার স্ত্রী বললেন,- “মন খারাপ করো না। এরপর থেকে ওর খাবার দাবারের ব্যাপারে তো আমরা খেয়াল রাখবো”।
আনোয়ার সাহেব বললেন – নওরিনের প্রতিদিন এক গ্লাস করে দুধ খাওয়া উচিত বুঝলে রেহানা। দুধ কিন্তু সবচেয়ে উত্তম খাবার। শরীরের জন্য ভালো।
আমাদের নবীজী কিন্তু দুধ খুব পছন্দ করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মিরাজের রাতে বায়তুল মুকাদ্দাসে আমি দুই রাকাত নামাজ পড়ে বের হলে জিবরাইল (আ.) আমার সম্মুখে শরাব ও দুধের আলাদা দুটি পাত্র রাখেন। আমি দুধের পাত্রটি নির্বাচন করি। জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি প্রকৃত ও স্বভাবজাত জিনিস নির্বাচন করেছেন।’ (বুখারি : ৩১৬৪, তিরমিজি, ২১৩)
নবীজী দুধ পান করার ফলে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বলেন, ‘আপনি ফিতরাতের ওপর বিজয়ী হয়েছেন। যদি আপনি পানি পান করতেন তবে, আপনার উম্মত বিপদের সম্মুখীন হয়ে যেত।
দুধ মহান আল্লাহর বড় একটি নেয়ামত। এ নেয়ামতের কথা পবিত্র কোরআনেও এসেছে রেহানা। সেটা হলো- “আর গবাদিপশুর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। তার উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।“ (সুরা নাহল : ৬৬)।
পৃথিবীবাসীর জন্য আল্লাহতায়ালা বেহেশতি যেসব খাদ্য ও পানীয় দান করেছেন তার মধ্যে দুধ অন্যতম। পবিত্র কোরআন শরিফে বেহেশতের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন – “আর পরহেজগার লোকদের জন্য যে জান্নাত দেওয়া হয়েছে তার উদাহরণ হচ্ছে তাতে তিনি পানির বহর, নির্মল দুধের নহর যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। সেখানে তাদের জন্য আছে রকমারি ফলমূল ও তাদের পালনকর্তার ক্ষমা। পরহেজগাররা কি তাদের ন্যায়, যারা জাহান্নামে অনন্তকাল থাকবে এবং যাদের পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি অতঃপর তা তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেবে।” (সূরা মুহাম্মদ : ১৫)
আনোয়ার সাহেবের কথামত দুধ খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের ধর্মে কিন্তু যথেষ্ট জোর দেয়া হয়েছে। দুধে এমন কিছু পুষ্টিগুণ আছে যার ফলে আমাদের সবার জন্যই দুধ এত উপাদেয় খাদ্য।
আসুন জেনে নেই দুধে কি কি পুষ্টি উপাদান আছে।
দুধের পুষ্টি উপাদান
দুধে প্রোটিন, চর্বি, শর্করা, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্যালরিসহ আরো অনেক উপাদান থাকে।
১. প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর দুধে যেসব পুষ্টি উপাদান থাকে।
প্রোটিন | ৩.৩ গ্রাম। |
চর্বি | ৩.৪ গ্রাম। |
শর্করা | ৪.৮ গ্রাম। |
ক্যালসিয়াম | ০.২ মিলিগ্রাম |
আয়রন | ২.০ মিলিগ্রাম। |
ক্যালরি | ৭১ কিলোক্যালরি |
Source:Wikipedia
এছাড়া দুধে আরো অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
২. গরুর দুধে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম।
৩. গরুর দুধের কম্পোজিশনে থাকে-
পানি | ৮৬. ৫% |
ল্যাকটোজ | ৪.৮% |
ফ্যাট | ৪.৫% |
প্রোটিন | ৩.৫% |
ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ | 0.৭% |
Source: Wikipedia
৪. কাঁচা দুধের পুষ্টির পরিমাণ বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে ভিন্ন হলেও তাতে প্রচুর পরিমাণে স্নেহ পদার্থ, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি পাওয়া যায়। আবার গরুর দুধ হল সামান্য অম্লজাতীয় ।
৫. এছাড়াও দুধে আছে ভিটামিন-এ, ডি, বি-১২, রিবোফ্লাভিন,ফসফরাস, মিনারেল ও পটাসিয়াম।
দুগ্ধজাত খাবার
দুধ থেকে তৈরি খাবার পৃথিবী সকল স্থানেই জনপ্রিয়। উপমহাদেশ এবং আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এখনো বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবারের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে।
দুগ্ধজাত পণ্য (Dairy products) বলতে আসলে মিষ্টান্নসহ দুধের তৈরি যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী গুলোকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
দুগ্ধজাত পণ্য (Dairy products) বলতে আসলে মিষ্টান্নসহ দুধের তৈরি যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী গুলোকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বহুকাল আগে থেকেই বাংলাদেশের মানুষের খাবারে দুগ্ধজাতপণ্য ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উল্লেখযোগ্য দুগ্ধজাত পণ্যগুলো হচ্ছে –
১. সর বা ক্রিম (cream), দই, ছানা, মাখন, ঘি, পনির, পুডিং প্রভৃতি। ক্রিমে স্নেহপদার্থের পরিমাণ শতকরা ১৮ ভাগের কম নয়, সাধারণত ১৮ থেকে ৮০ ভাগের মধ্যে থাকে। এটি স্থানীয়ভাবে সর, মালাই হিসেবেও পরিচিত। মাখন, ঘি ও আইসক্রিম তৈরিতে ক্রিমের ব্যবহার ব্যাপক।
২. দুধ থেকে তৈরী হয় দই। যা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাতে কিংবা দুপুরের খাবারের পর মিষ্টান্ন হিসেবে আমরা গ্রহণ করি।
৩. দুধ থেকে পনির তৈরি করা যায়। এজন্য প্রথমে দুধের ঘনীভূত অংশ থেকে জলীয় অংশ আলাদা করার জন্য ছোট ছোট টুকরা করা হয়। ঘনীভূত দুধ শুকানো হয়, লবণ মিশানো হয়, তারপর চাপ প্রয়োগে পনিরের চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়।
৪. দুধ থেকে তৈরি হয় ছানা। ছানা ফুটন্ত দুধে পর্যাপ্ত টক, ছানার পানি, লেবুর রস বা সাইট্রিক এসিড দ্রবণ মিশিয়ে জমানো দুধের স্নেহপদার্থের (entrained milk fat) সঙ্গে আমিষ পৃথক করে তৈরি করা হয়। ছানাকে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করা যায় নানাধরনের মিষ্টি, যেমন রসগোল্লা, সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, চমচম, মন্ডা, রসমালাই, ছানামুখী প্রভৃতি।
৫. খাবারে স্বাদ আনে ঘি। শক্তির ঘনীভূত উৎস এই ঘি, যা তৈরি করার প্রধান উপাদানই হলো দুধ। ঘি মূলত শোধনকৃত মাখন; এর মধ্যে প্রায় ৯৯.৭ ভাগ দুগ্ধ-স্নেহপদার্থ থেকে থাকে। গরু ও মহিষ উভয়ের দুধ থেকেই এটা তৈরি করা যায়। বাংলাদেশে পোলাও, বিরিয়ানি, রোস্ট, কোরমা ও এ ধরনের অন্যান্য সুস্বাদু খাদ্য তৈরিতে বহুলভাবে ঘিয়ের ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে।
৬. গ্রাম বাংলা বিভিন্ন পিঠা তৈরিতে দুধের বিকল্প নেই। দুধ চিতই, সেমাই পিঠা, দুধ পুলি, পায়েস, সেমাই এছাড়া অতি জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু খাবার ফালুদা তৈরি করতেও প্রয়োজন দুধ।
৭. কর্মব্যস্ত জীবন কিংবা আড্ডায় দুধ চায়ের জুড়ি নেই। গরুর খাঁটি দুধের এক কাপ গরম গরম চা আর বিকেলের আকাশ এসবের কোন অন্য বিকল্প হয় না।
তাই, সর্বোপরি দুধ আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী এমন একটি খাবার যেটি শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্যই অত্যাবশ্যকীয়।