গত পর্বে ছিলো নারিকেল তেল নিয়ে কিছু হালকা রসালো আলাপ। কারণ আমরা সাধারণত নারিকেল তেলকেই ঘনকালো চুলের যত্ন নিতে বেশি ব্যবহার করি। কিন্তু শুধু নারিকেল তেল নয়, বেশ কিছু তেলই খাওয়ার পাশাপাশি চুলেও ব্যবহার করতে পারেন। একেক তেলে রয়েছে একেক ধরনের পুষ্টিগুণ। বিভিন্ন তেল ব্যবহারের মাধ্যমে সব পুষ্টি নিয়ে আসতে পারেন আপনার চুলের জন্য। এবারের সাতকাহন হবে বাকি তেল গুলো নিয়ে।
চুলের যত্নে যয়তুন তেল
চুলের যত্ন নিতে যয়তুন তেল অনেক বেশি উপকারি। এটি সরাসরিও চুলে ব্যবহার করা যায়, এতে কোনো প্রকার ক্ষতি হয় না।
যেমন-
১. একটি চিরুনি যয়তুন তেলের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়ে তারপর ফ্রিজি চুলে আঁচড়ে নিন। এতে আপনার চুল ময়েশ্চার হয়ে ফ্রিজিনেস কেটে যাবে।
২. প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবেও যয়তুন তেল ব্যবহার করতে পারেন। শ্যাম্পু করার পর হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা যয়তুন তেল নিয়ে ভালো ভাবে দুই হাতে ঘষে ফেলুন। তারপর চুলে কন্ডিশনারের বদলে লাগিয়ে ফেলুন।
৩. সপ্তাহে অন্ততপক্ষে একবার হালকা গরম যয়তুন তেল চুলে ভালো ভাবে ম্যাসাজ করে লাগাতে পারেন। এভাবে ২/৩ ঘণ্টা চুলে তেল লাগিয়ে রেখে শ্যাম্পু করুন। তারপর নিজেই লক্ষ্য করবেন শাইনি আর স্বাস্থ্যকর চুলের বাহার।
৪. সপ্তাহে ২ দিন ব্যবহার করলে ভালো উপকার পাবেন।
৫. মাথায় যয়তুন তেল ম্যাসাজ করে গরম পানিতে ডুবানো তোয়ালে দিয়ে মাথা পেঁচিয়ে নিতে হবে। খেয়াল রাখবেন তাপমাত্রা যেন সহ্য ক্ষমতার মধ্যে থাকে। তোয়ালে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মাইক্রোওয়েভে আবার গরম করে নিন। এভাবে কয়েকবার করতে পারেন।
৬. চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে যয়তুন তেলের জুড়ি নেই। তার জন্য কিছু বাড়তি উপাদান ব্যবহার করলে উপকার বেশি পাওয়া যাবে। তার জন্য, একটি ডিমের কুসুমের সাথে ২ টেবিল চামচ যয়তুন তেল, ৫ ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে চুলে ১৫ মিনিট লাগিয়ে রাখুন তারপর ধুয়ে ফেলুন। আপনার চুল হয়ে উঠবে নরম আর উজ্জ্বল।
৭. শীতের সময় প্রকৃতিতে শুষ্কতার প্রভাব পড়ে চুলেও। আপনার চুলও হতে পারে শুষ্ক। তাই এ শুষ্কতার জন্য যয়তুন তেল ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে। তবে যয়তুন তেল খুব আস্তে আস্তে কাজ করে চুলের ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলে।
৮. অনেকের মাথার চুলকানির সমস্যা থাকে। সেক্ষেত্রে, এক টেবিল চামচ যয়তুন তেলের সাথে চার পাঁচ ফোঁটা নিমের তেল মেশান। এই তেলের মিশ্রণটি মাথার তালুতে ৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন। ১৫-২০ মিনিট পর শ্যাম্পু করে ফেলুন। এটি মাথার তালুর চুলকানি রোধ করে।
৯. এই তেল সাধারণত স্পর্শকাতর চুলের জন্য। এতে রয়েছে চুলের উপযুক্ত দারুণ কন্ডিশনার। এর কোনো অ্যালার্জেটিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। স্কাল্প বা মাথার খুলির স্বাস্থ্যের জন্য এটি বেশ কাজ করে। কেননা এতে আছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামাটরি ময়েশ্চারাইজিং।
আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে প্রাচীনকাল থেকেই ঔষধি গাছ হিসেবে পরিচিত নিম। তবে শুধু ত্বকে নয় চুলের যত্ন নিতেও নিমপাতা উপকারী।
১. মাথার ত্বকের যে কোনো ক্ষতি পূরণ করতে নিম তেল সাহায্য করে। অর্থাৎ মাথার ত্বকের যদি কোনো ধরনের সমস্যা থাকে তাহলে নিমতেল ব্যবহার করুন।
২. নিমতেলে নিরাময়কারী উপাদান মাথার ত্বকের শুষ্কতা ও চুলকানি দূর করতে সাহায্য করে। শুষ্ক চুল কিংবা চুলকানি রোধ করতে ব্যবহার করতেপারেন নিমের তেল।
৩. এছাড়াও এই তেল মাথার ত্বকের যে কোনো ‘মাইক্রোবায়াল’ সংক্রমণ দূর করতে সহায়তা করে।
৪. উকুনের যন্ত্রণা বেশ বিরক্তকর। এই সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে নিমের অয়েল। মাথায় নিমের অয়েল ম্যাসাজ করুন। এভাবে সারারাত থাকুন। পরের দিন সকালে একটি চিকন দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ান। দেখবেন উকুন চলে আসছে। নিমের তেল মাথার তালুতে কোন বিরুপ প্রভাব ফেলবে না।
৫. এই তেলের মিশ্রণটি মাথার তালুতে ৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন। ১৫-২০ মিনিট পর শ্যাম্পু করে ফেলুন। এটি মাথার তালুর চুলকানি রোধ করে।
৬. একটি ডিমের সাদা অংশের সাথে বিশ ফোঁটা নিমের অয়েল ভাল করে মেশান। এই মিশ্রণটি চুলে ব্যবহার করুন। ঘন্টাখানিকপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। এটি চুল স্বাস্থ্যজ্জল ও ঝলমলে করে তোলে। এবং চুলে কন্ডিশনারের কাজ করে।
“বুখারী শরিফ” এ বলা হয়েছে, ‘তোমরা কালো জিরা ব্যবহার কর, নিশ্চয়ই সকল রোগের নিরাময় ইহার মধ্যে নিহিত রয়েছে- মৃত্যু ছাড়া’।
কালোজিরার তেলে ১০০টিরও বেশি উপযোগী উপাদান আছে। এর মধ্যে প্রায় ২১ শতাংশ আমিষ, ৩৮ শতাংশ শর্করা এবং ৩৫ শতাংশ ভেষজ তেল ও চর্বি আছে। এটি নিয়মিত সেবনে নানা ধরণের উপকারিতা পাওয়া যায়।
মাথায় ব্যবহারের জন্য যতটুকু পরিমাণ নারিকেল তৈল লাগে তার ৪ ভাগের ১ ভাগ পরিমাণ কালিজিরার তৈল মিশ্রিত করে মাথার চুলে লাগাতে পারেন। সপ্তাহে এক বা দুই দিন কালিজিরার তেল ব্যবহার বিধি অনুযায়ী লাগানো যেতে পারে
ব্যবহার বিধি
১.অনুপাতে যয়তুন তেল এবং কালিজিরার তেল মিশিয়ে চুলের গোড়ায় গোড়ায় ম্যাসাজ করে লাগিয়ে নিন। এর পর একটি নরম তোয়ালে কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে এবং পানি নিংড়ে পুরো চুল মুড়িয়ে মাথায় লাগিয়ে রাখুন ৪০ থেকে ১ ঘন্টা সময়ের জন্য। নিয়ম করে সমতাহে ২ বার এভাবে চুলের যত্ন নিলে নতুন চুল গজায়।
২. চুলের দৈর্ঘ্য বাড়াতেও এই তেল আপনার উপকারে আসবে।
৩. এই তেল চুলের উকুন কমাতেও আপনাকে সাহায্য করে।
আগে রান্নাবান্নার পাশাপাশি ত্বক ও চুলের যত্নেও সরিষার তেলের ব্যবহার ছিল। যুগ বদলের সাথে সাথে এখনকার দিনের নারীরা চুলের যত্নে নারিকেল তেল বেছে নিয়েছেন।
অথচ দূষণ, পানি, রাসায়নিক ইত্যাদির প্রভাবে আমাদের চুল রুক্ষ, শুষ্ক হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা ও চুল পড়া বন্ধ করায় যে সরিষার তেলের জুড়ি নেই তা অনেকেই জানেন না।
১. সরিষার তেলও ভালো কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে। সরিষার তেলে আলফা ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা চুল সুন্দর, স্বাস্থ্যজ্জল রাখে। এছাড়া আলফা ফ্যাটি অ্যাসিড দারুণ কন্ডিশনারের কাজ করে। ফলে আপনার চুল দ্রুত বৃদ্ধি হয়।
২. সরিষার তেল চুলে পুষ্টি জোগায়। আজকাল চুল পড়া খুবই সাধারণ সমস্যা। এর একটি কারণ হতে পারে চুলের ফলিকল দুর্বল হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া। চুলে নিয়মিত সরিষার তেল মালিশ করলে ফলিকল মজবুত হয়ে চুল পড়া বন্ধ হবে।
৩. সরিষার তেল আপনার চুল লম্বা হতে সাহায্য করে। কারণ, এতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি মিনারেল এবং ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে থাকে। এছাড়াও থাকে জিঙ্ক, বিটা ক্যারোটিন ও সেলেনিয়াম যা চুল লম্বা হতে সাহায্য করে।
৪. আপনার চুল রুক্ষ, শুষ্ক, নিষ্প্রাণ হয়ে গেলে নিয়মিত মাথার তালুতে সরিষার তেল মালিশ করতে পারেন। এর ফলে মাথার তালুতে রক্ত সঞ্চালন ঠিকভাবে হবে এবং চুলের গোড়া মজবুত হয়ে চুল পড়া বন্ধ হবে।
৫. সরিষার তেলে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা আপনার চুল বড় হতে সাহায্য করবে।
৬. চুলের খুশকি দূর করতে সরিষার তেল অনেক উপকারি। এতে আছে অ্যান্টি ফাঙ্গাল উপাদান। যা চুলের খুশকি ও চুলকানি দূর করে। ফাঙ্গাসে চুলের গোড়া বুজে গিয়ে চুল পাতলা হয়ে যায়। সে সমস্যা সমাধান করে সরিষার তেল।
৭. চুলের অকালপক্কতা রোধ করতে সরিষার তেল খুবই কার্যকরী। সরিষার তেলের পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন এবং মিনারেল চুলের অকালপক্বতা রোধ করে। প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে চুল এবং মাথার তালুতে ম্যাসেজ করুন।
৮. চুল পাতলা জনিত সমস্যা থেকেও সরিষার তেল আপনাকে রক্ষা করতে পারে। সরিষার তেলে প্রচুর পরিমানে বিটা ক্যারোটিন আছে। যা মাথার তালুতে ম্যাসাজ করার ফলে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
আদিকাল থেকে চুলের যত্নে শুধু নারিকেল তেল ছাড়াও আরো অনেক তেলের প্রয়োজন রয়েছে সেগুলো আমাদের অনেকেরই অজানা।
প্রয়োজন অনুযায়ী তেল বাছাই করে চুলকে স্বাস্থ্যকর, উজ্জ্বল, মসৃণ, ঘন, কালো এবং জীবাণুমুক্ত রাখতে যে এইসব তেলের প্রয়োজন কতটা তা এদের উপকারিতা, গুণাগুণ এবং এবং এদের পুষ্টি উপাদান পর্যালোচনা করলেই জানা যায়।
তবে এই সময়ে এসে ভেজাল কিংবা সঠিক পন্য চিনে নিতে আমাদের হয়রানীর শেষ নেই। কারণ প্রতিটা তেলেই এক্সট্রা ঝাঁজ যুক্ত করে এসব তেল বিক্রি করছে ভেজালকারীরা। তাই খাঁটি তেল কিনে সঠিকভাবে চুলের যত্ন নিন আজ থেকেই। কারণ আমাদের সুন্দর চুলও আমাদের শারীরিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলে।