সামিরার সামনে এতো এতো খেলনা থাকা স্বত্বেও কেনো যেনো পুতুল খেলার প্রতি তার এক অমোঘ আগ্রহ। দুই বছরের শিশু সামিরা যেনো তার পুতুলের মা হয়ে উঠেছে। নারী মাত্রই জীবনের কোন এক সময় মাতৃত্বের স্বাদ নিবে, এটা যেনো এক অবধারিত ব্যাপার। আর তাই হয়তো ছেলেবেলায় সামিরার মতন মেয়ে শিশুরা পুতুল খেলায় মেতে ওঠে, সেই পুতুলকে আগলে রাখে নিজের সন্তানের মতন। এমনকি বয়সের পরিক্রমায় বাবা মায়েরও মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ওঠে একজন মেয়েই। কিন্তু এই নারী যখন সত্যিকার অর্থে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে প্রস্তুত হয় তখন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার গ্লানিতে আচ্ছাদিত হতে হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য দায়ী থাকতে পারেন পুরুষও। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর পিছে দায়ী হিসেবে আবর্তিত হয়ে ওঠেন একজন নারী নিজেই। অথচ সমাজ ভুলে যায় মাতৃত্ব সবচেয়ে বেশি আরাধ্যের একজন নারীর কাছেই। গত পর্বে আমরা জেনেছিলাম পুরুষ কীভাবে সন্তান জন্মদানে অক্ষম। আর আজ জানবো নারীর মাতৃত্ব নিয়ে।
আগের পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নারী যখন মাতৃত্বের স্বাদ নিতে অক্ষমঃ
পুরুষের ন্যায় নারীর সন্তান জন্মদানের ব্যাপারও প্রজনন তন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত। সাধারণত নারীর প্রজনন তন্ত্র ডিম্বানু তৈরি, পরিপক্ক ডিম্বানু ধারণ ও নিষেকের জন্য পরিবহন এবং পরবর্তীতে নিষিক্ত ডিম্বানু থেকে ভ্রূণ ও ফিটাস তথা পরিপূর্ণ মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পাদন করে। এই পুরো প্রক্রিয়া যদি কোন না কোন ভাবে বাঁধাগ্রস্থ হয় তখনই দেখা যায় নারী সন্তান জন্মদানে অক্ষম তথা বন্ধ্যা হিসেবে আবির্ভূত হন।
নারীর বন্ধ্যাত্বের কারণঃ
শারীরিক ও মানসিক নানান কারণেই বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকিতে থাকেন নারী। কিন্তু এর সাথে পারিপার্শ্বিক কারনও কম গুরুত্ববহ নয়।
১। ওভ্যালিউশন জনিত সমস্যাঃ যখন একজন নারী পর্যাপ্ত পরিমাণে সুস্থ ডিম্বানু তৈরি করতে পারেন না তখন নারীর বন্ধ্যাত্ব দেখা যায়। এক্ষেত্রে নারীর সার্বিক সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২। ফেলোপিয়ান টিউবে সমস্যাঃ জরায়ুর দুইপাশে দুইটি ফেলোপিয়ান টুব উপস্থিত। এই দু’টি ফেলোপিয়ান টিউব ডিম্বাশয় থেকে পতিত পরিপক্ক ডিম্বানু জরায়ুতে পৌঁছে দেয় এবং শুক্রাণুকে পরিপক্ক ডিম্বানুর দিকে বয়ে নিয়ে যায়। যদি ফেলোপিয়ান টিউবে কোন সমস্যা দেখা দেয় তখন ডিম্বানু নিষিক্ত হতে পারে না ফলে নারী বন্ধ্যাত্বের দিকে এগিয়ে যায়।
৩। এন্ড্রোমেট্রিওসিসঃ এন্ড্রোমেট্রিওসিস মূলত এমন এক অবস্থা যা সহজে নির্ণয় করা যায় না। জরায়ুর সবচেয়ে ভিতরে যে স্তর সেটি এন্ডোমেট্রিয়াম নামে পরিচিত। এই স্তর জরায়ুর ভিতর দিকে অবস্থান করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কোষ বিস্তার লাভ করে জরায়ুর বাইরের স্তরে। এমনকি ডিম্বাশয়, ফেলোপিয়ান নালী, বিভিন্ন লিগামেন্টেও জমা হতে পারে এই কোষ। আর এমতাবস্থায় একজন নারী এগিয়ে যায় বন্ধ্যাত্বের দিকে।
৪। জন্মগত ত্রুটিঃ কিছু ঔষধ আছে যার প্রভাবে গর্ভস্থ ফিটাসের অঙ্গ পরিপুর্ণ ভাবে বিকশিত হতে পারে না, বিশেষ করে প্রজনন তন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। আর প্রজনন তন্ত্রের এই জন্মগত ত্রুটি একজন নারীকে বন্ধ্যাত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
৫। ইনফেকশনঃ পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ বা PID এমন এক ইনফেকশন যা গনোরিয়া বা ক্ল্যামিডিয়া ব্যাকটেরিয়ার জন্য হয়ে থাকে। এই ইনফেকশনে জরায়ু, ফেলোপিয়ান টিউব, ডিম্বাশিয়ের যেকোন একটা বা এই তিনটাকেই আক্রান্ত হতে পারে। যার ফলে একটোপিক প্রেগনেন্সি দেখা দিতে পারে। একটোপিক প্রেগ্নেন্সিতে নিষিক্ত ডিম্বানু জরায়ুতে প্রোথিত না হয়ে জরায়ুর বাইরে প্রোথিত হয়। যার ফলে প্রাথমিকভাবে গর্ভসঞ্চার হয়েছে মনে করা হলেও আদতে তা হয় না এবং এক পর্যায়ে বন্ধ্যাত্বের দিকে নিয়ে যায়।
৬। দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাঃ দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত ভাইরাস, ব্যকটেরিয়ার মতন অনুজীব প্রতিহত করে আমাদের সুস্থতায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যই গর্ভধারণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেমন, কিছু ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চার হলেও দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গর্ভধারণকে জীবনের জন্য হুমকি মনে করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেহে অ্যান্টিস্পার্ম অ্যান্টিবডি তৈরি করে যা স্পার্মকে আক্রান্ত করে এবং ধ্বংস করে ফেলে। এক্ষেত্রেও সূচনা হয় বন্ধ্যাত্বের।
৭। হরমোনজনিত সমস্যাঃ যখন কোন কারণে দেহে প্রজনন হরমোনগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয় তখন গর্ভধারণ করা অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে উঠে না।
৮। সিস্টঃ ওভারিতে সিস্ট বর্তমানে মেয়েদের খুবই সাধারণ এক সমস্যা যা পরিণাম হতে পারে বন্ধ্যাত্বও। শুধু ওভারিতেই নয়, ডিম্বাশয় বা ফেলোপিয়ান নালীতেও দেখা মিলে এইসব সিস্টের।
আগের পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যারা আছেন ঝুঁকিতেঃ
১। অনিয়মিত মাসিকঃ নারীদের স্বাভাবিক মাসিক চক্র সাধারণত ২৮ থেকে ৩২ দিনের হয়ে থাকে। আর এই চক্র গর্ভধারণের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যদি কারও টানা বেশ কয়েক মাস ধরে মাসিক অনিয়মিত হয়ে ওঠে, যেমন মাসে দুইবার বা দুই তিন মাস পর একবার করে রজোচক্র হয় তবে সেই নারী বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকিতে আছেন বলে বিবেচনা করা যায়।
২। অটোইমিউন ডিজিজঃ অটোইমিউন ডিজিজ এমন এক শারীরিক অবস্থা যেখানে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দেহকে প্রতিরক্ষা দান করার বদলে আক্রান্ত করে। যদি কোন নারী কোন অটোইমিউন রোগের আক্রান্ত থাকে তবে তার বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি রয়েছে।
৩। রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যাঃ কারও দেহে রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যা থাকলে গর্ভসঞ্চারে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪। সার্ভিক্সে সমস্যাঃ জরায়ুর নিচের দিকের অংশ হচ্ছে সার্ভিক্স। সার্ভিক্সে সমস্যার কারণেও নারী সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার দিকে ধাবিত হতে পারেন।
৫। ডায়াবেটিসঃ সুস্থ নারী অপেক্ষা যেসব নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের মধ্যে গর্ভধারণে ঝুঁকি বেশি দেখা দেয়।
৬। এন্ডোমেট্রিওসিসঃ এন্ডোমেট্রিওসিসে জরায়ুর ভিতরের দিকের কোষ বা এন্ডোমেট্রিয়াম জরায়ুর বাইরে এবং বিভিন্ন প্রজনন অঙ্গের গাত্রে অবস্থান করতে পারে। এমতাবস্থায় নারীর বন্ধ্যা হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
৭। পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজঃ পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি রোগে আক্রান্ত হলে মূলত প্রজনন তন্ত্র বিশেষ করে ইউটেরাস, ফেলোপিয়ান নালী এবং ডিম্বাশয়ে ইনফেকশন দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত হলেও বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
৮। যৌনবাহিত রোগঃ বিভিন্ন ধরনের যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হলেও গর্ভসঞ্চারের ক্ষমতা হ্রাস পায়।
নারীর বন্ধ্যাত্ব নির্ণয়ের পদ্ধতিঃ
১। রক্ত পরীক্ষাঃ রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় যে নারীর ওভ্যুলেশন ঠিকমতো হচ্ছে কি না, হরমোনের ভারসাম্য ঠিক আছে কি না। কেননা, ওভ্যুলেশন ঠিক মতো না হলে বা হরমোনের ভারসাম্য ঠিক না থাকলে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি থাকে।
২। ওভারিয়ান রিসার্ভ পরীক্ষাঃ ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা হয় যে একজন নারীর ডিম্বাশয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম্বানু আছে কি না এবং সেই উপস্থিত ডিম্বানু কি মাত্রায় আছে, সেগুলোর প্রকৃতি কেমন।
৩। পোস্ট কইটাল টেস্টঃ সহবাসের পর নারীর সার্ভিক্সের মিউকাস পরীক্ষা করে দেখা হয় যে বিদ্যমান সিমেন কি অবস্থায় আছে।
৪। এন্ডোমেট্রিয়ামের বায়োপসিঃ বায়োপসি করার মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে জরায়ুর কোষ বিভাজনের কি অবস্থা এবং ওভ্যুলেশন ও হরমোনের মাত্রা ঠিক আছে কি না।
বন্ধ্যাত্ব নিঃসন্দেহে এক হৃদয়বিদারক শারীরিক অবস্থা। কিন্তু এই অবস্থা থেকে উত্তরণে চাই এই ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা।
Source: