দিনবদলের পরিক্রমায় বাংলায় চলে এসেছে শীতকাল। শীতকাল আসলেই মাসুষের জীবনধারায় আসে নানা ধরনের পরিবর্তন। শীত আসলেই শুরু হয় নবান্ন উৎসব। প্রতিটি গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় পড়ে যায় পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম। বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে শীতের পিঠা-পুলি এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাওয়া যায়। শীতকাল আসলে সবচেয়ে বেশি যে খাবারটির কথা মনে পড়ে সেটি হলো খেঁজুরের গুঁড়। সব জেলাতে খেঁজুরের গুঁড় পাওয়া না গেলেও দক্ষিণ বঙ্গের কিছু কিছু জেলাতে খেঁজুরের রস পাওয়া যায় শীতকাল আসলেই। সবচেয়ে বেশি খেঁজুরের রস উৎপাদিত হয় যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কুষ্টিয়া ও মাগুরা জেলাতে। ঢাকা খুলনা মহাসড়ক ধরে যাবার সময়ই রাস্তার পাশে সারি সারি খেঁজুর গাছ চোখে পড়ে। ১৯৪০ সালের দিকে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলাতে এই শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। যা এই জেলাগুলোকে খেঁজুর রস উৎপাদনে খ্যাতি এনে দিয়েছে।
খেঁজুরের রস মূলত আহরণ করা হয় খেঁজুর গাছ থেকে। রস সংগ্রহের পূর্বে অগ্রহায়ণের শেষের দিকে গাছের কান্ডের একেবারে উপরের অংশে পাতা ও ডালপালাগুলি পরিষ্কার করা হয়। এর কান্ডের নরম অংশে ধারালো ছুরি বা দা দিয়ে চেঁছে বাকল তুলে ফেলা হয়। এর সাত থেকে আট দিন পর পুনরায় পরিষ্কার করা হয় বা চাঁছা হয়। পরিষ্কার করা অংশে ছোট গর্ত করে বাঁশের তৈরী নল পুঁতে দেওয়া হয়। যাতে রস বের হয়ে নলে আসতে পারে। এরপর নলের দুইপাশে দুইটা খুটিমত পুঁতে দেওয়া হয় যা মাটির হাঁড়ি ঝুলানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। হাঁড়িতে বাধা দড়ি দুই খুটিতে বেধে নল বরাবর ঝুলিয়ে রাখা হয় ফলে রস একদম নল বেয়ে সোজা হাঁড়িতে পড়ে। রস আহরণের সময়কালের উপর ভিত্তি করে রসকে তিনভাগে ভাগ করা হয় যথা জিড়ান, দোকাট ও ঝরা রস। প্রথম রাতে যে রস পাওয়া তা জিড়ান এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন যে রস পাওয়া যায় তাকে দোকাট ও ঝরা রস বলে। খেজুরের রস কি পরিমান হবে তা নির্ভর করে আবহাওয়ার উপর। আবহাওয়া যদি শীতার্ত ও পরিচ্ছন্ন হয় তবে রস বেশি হয়। নভেম্বরে রস আহরণ শুরু হলেও জানুয়ারি মাসের দিকে সবচেয়ে বেশি পরিমানে রস পাওয়া যায়।
যারা খেঁজুরের রস সংগ্রহ করেন ও গাছ কাটেন তাদের বলা হয় গাঁছি। এই গাঁছিরা প্রতিদিন সকালে ভোরে রস সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন হাঁড়িতে। এরপর এই রসকে ছেঁকে নেয়া হয়। ছাঁকা রসকে বড় টিন বা কড়াই বা তাফালে ঢেলে জ্বাল দেওয়া হয়। এভাবে ক্রমাগত জ্বাল দিতে দিতে রস ঘন হয়ে যায়। আরো ঘন হলে একে বলা হয় ঝোলা গুঁড় এছাড়া ঘন এই গুড় দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির পাটালিগুড় তৈরী করা হয়। খেঁজুরের গুঁড় ধরন অনুযায়ী এই গুঁড়কে ঝোলা গুঁড় , দানাগুঁড় , পাটালিগুঁড় ও চিটাগুঁড় এই সকল ভাগে ভাগ করা হয়। খেজুরের রস ও গুড় খুবই সুস্বাদু। এই গুড় দিয়ে আমাদের দেশে নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা কিংবা খাবার বানানো হয় যা স্বাদে ও ঘ্রাণে অতুলনীয়। তেমনি কয়েকটি খাবার হলো ভাপাপিঠা, পায়েস, ক্ষীর, দুধ চিতুই পিঠা, দুধ পুলি পিঠা, তালের পিঠা, গুঁড় জিলাপি, সেমাই, শরবত, গুড়ের চা ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশে এই গুঁড় দিয়ে তৈরী খাবারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো ভাপা পিঠা। কৃষকের ঘরে নতুন ধান উঠার সাথে সাথেই সেই ধানের চাল দিয়ে তৈরী করা হয় ভাপা পিঠা। কুয়াশামাখা সকাল কিংবা শীতার্ত রাতে উনুনের পাশে বসে মায়ের হাতের ভাপা পিঠা খাওয়া যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাললাগা। এছাড়া শীতকালে শহরের ওলি-গলিতে গড়ে ওঠে ছোট্ট ফোট্ট ভাপা পিঠার দোকান যেখান থেকে শহরের মানুষও তাদের তৃপ্তি মেটান। এই গুড় যেমনি সুস্বাদু তেমনি বহু পুষ্টিগুণে গুনান্বিত। গুরুত্বপূর্ণ কিছু পুষ্টিগুন সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
যারা মিষ্টিকে যমের মত ভয় পান তাদের জন্য এই গুড় একদম পারফেক্ট। কারন এই খেঁজুরের গুঁড় সম্পুর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় তৈরী করা হয় এবং একে সাদা করার জন্য কোনো হাইড্রোজ বা অন্য কেমিক্যাল যুক্ত করা হয়না ফলে এর রং ও স্বাদ থাকে অক্ষুন্ন। এই গুঁড় দেখতে বাদামী এবং খুবই স্বাস্থ্যকর। তাই যে কেউ নিশ্চিতে খেতে পারবেন এই গুড়। এছাড়া এই গুড়কে রিফাইনিং করা হয়না ফলে এটি থাকে শতভাগ নিরাপদ।
শীতকাল আসলেই ত্বক অবস্থা খুব বাজে হয় যায়। বেশিরভাগ সময়ই ত্বক থাকে অমসৃণ। বিশেষজ্ঞদের মতে নিয়মিত এই গুড় খেলে ত্বকের উজ্জলতা বাড়বে এবং ত্বক হবে মসৃণ। কারন এতে রয়েছে নানা ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল। এছাড়া যাদের মুখে ফুসকুড়ি ও ব্রণ হয় তারাও খেতে পারেন এই গুড়।
যার দীর্ঘদিন যাবত কোষ্ঠাকঠিন্য রোগে ভুগছেন। তাদের জন্য দারুন একটি সমাধান হলো এই গুড়। কেউ যদি গুড় নিয়মিত খায় তবে তার দেহে পাচক ক্রিয়ায় ব্যবহৃত এনজাইমগুলো সক্রিয় হয়ে যাবে এবং ইলিমিনিনেশন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমে যাবে সহজেই। দুপুরের খাবারের পর এক টুকরা পাটালি আপনার এই গুরুতর সমস্যাকে দূর করবে সহজেই।
এই গুড় দেহের প্রাকৃতিক পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। এটি নিয়মিত খেলে আমাদের লিভারে উপস্থিত বিষাক্ত পদার্থ সমুহ শরীর থেকে বের করতে সহায়তা করে। তাই বলা যায় এই গুড় আমাদের লিভারকে ডিটক্সিফাই করে দেয়।
শীতকাল আসলেই নিউমোনিয়া, ফ্লু, ঠান্ডা, কাশি ও জ্বর ইত্যাদি হওয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। এই সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে গুড়। কেউ যদি এক টুকরা খেজুর গুড় কুসুম গরম পানিতে দিয়ে খায় তবে নিমেষেই দূর হবে ঠান্ডাজনিত সকল সমস্যা। তাছাড়া চায়ের সাথে চিনির বদলে এই গুড় খেতে পারেন।
খেঁজুরের গুঁড়র সবচেয়ে সুপরিচিত উপকারীতা হলো এটি রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। নিয়মিতভাবে এবং পরিমিত পরিমানে এই খেঁজুরের গুঁড় খেলে খুব সহজেই আমাদের রক্ত পরিষ্কার হবে এবং রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটা কমে যাবে।
এই গুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস ও মিনারেল যেমন জিংক ও সেলেনিয়াম যা আপনার দেহের ফ্রি র্যাডিকেলকে প্রশমিত করে দেয় এবং মারাত্বক রোগ যেমন ক্যান্সারের ঝুকি কমায়। সর্বোপরি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলারা অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা নামক রোগে ভুগে থাকেন। এই রোগটি মূলত দেহে আয়রন ও ফলিক এসিডের অভাব হলে হয়ে থাকে। এই গুড়ে রয়েছে প্রচুর আয়রন ও ফোলেট যা রক্তের মূল উপাদান হিমোগ্লোবিন তৈরীর আসল যৌগ। হিমোগ্লোবিন যত বেশি তৈরী হবে তত বেশি রক্ত উৎপাদন হবে দেহে। ফলে রক্তস্বল্পতাও দুর হবে।
তাছাড়া এই গুড়ে সোডিয়াম ও পটাসিয়াম নামক মিনারেল থাকায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। হাড়ের জয়েন্টে ব্যাথা কমাতে সহায়তা করে।
অনেকেই আছেন অতিরিক্ত দূষিত এলাকায় কাজ করেন। তাদের শরীর পরিষ্কারের জন্য এই গুড় একটি প্রাকৃতিক পরিষ্কারক। তাদের দেহ থেকে দূষিত বর্জ্য বের করে দেয় এই গুড়। এই গুড়ে রয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মিনারেল সেটি হলো পটাসিয়াম যা আপনাকে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। ফলে আপনি স্থুলতার হাত থেকে রেহাই পাবেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ঐতিহ্যবাহী এই খাবার কতটা পুষ্টিকর।
এবার তাহলে জেনে নেয়া যাক আসল খেজুরের গুড় চেনার উপায় সম্পর্কে। কেনার সময় গুড় মুখে নিয়ে দেখুন যদি স্বাদ নোনতা মনে হয় তাহলে সেটি আসল গুড় না। গুড় হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে দেখুন গুড়ের ধার যদি নরম হয় তাহলে বুঝবে এই গুড় ভালো মানের। মুখে নেওয়ার পর স্বাদ যদি একটু তেতো মনে হয় তাহলে বুঝবেন এই গুড়টিতে স্যাকারিন বা হাইড্রোজ বেশি হয়ে গেছে। সুতরাং এমন গুড় এড়িয়ে চলুন।
সাধারনত গুড়ের রং বাদামী হয়। তাই বাদামী রং দেখেই গুড় কিনুন তাহলে আসল গুড় পাবেন। খাস ফুড আপনাদের জন্য সুদূর যশোর ও ঝিনাইদহ থেকে সরাসরি নিজেদের তত্বাবধানে প্রশিক্ষিত কৃষকের মাধ্যমে গুড় সংগ্রহ করে থাকে তাই এই গুড় ভেজাল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গুড় তৈরীর প্রতিটি ধাপে মেনে চলা হয় স্বাস্থ্যবিধি তাই এই গুড়ের ঘ্রাণ ও স্বাদ অতুলনীয়। আমাদের এই গুড়ের ঘ্রাণ ও স্বাদে আপনি একেবারে বিমোহিত হয়ে যাবেন। তাই শতভাগ বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খেজুরের গুড় নিতে খাস ফুডের সাথেই থাকুন।