কোরবানি

কোরবানির গরু লালন পালন প্রক্রিয়া

কোরবানির-গরু-লালন-পালন-প্রক্রিয়া

কোরবানির গরু লালন পালন বর্তমানে বেশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। কোরবানির পশুদের জন্য আয়োজন করা হয় পাঁচ তারকা মানের সুযোগ সুবিধা।

কোরবানীর মৌসুমে হেঁটে যাওয়া গরুর দড়ি দেখে গরু চেনা যায়। সচরাচর দড়ির একপ্রান্তে থাকে গরু এবং অন্য প্রান্তে গর্বিত সদ্য মালিক। টানটান দড়ি মানে গরুটি একটু বেয়াড়া। হাঁটতে অনীহা অথবা অতি উৎসাহী। ঢিলেঢালা দড়ি মানে গরুর ব্যক্তিত্ত্ব নেই। যেদিকে টান, সেদিকে যান!

কোরবানীর গরু নিয়ে পাড়া বেড়ানো আর গরু ছুটে গেলে পিছে দৌড়ানো ছোটদের ইদ আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ। ইদের আগের দিন সন্ধ্যার পর পাড়ায় ঘুরে ঘুরে প্রতিবেশীদের গরু না দেখা পর্যন্ত আমার ইদ যেন অপূর্ণ থেকে যায়।

ইদানীং আগের মতো তেজী বেয়াড়া গরু খুব একটা চোখে পরে না। আগে গরুর পেছন দিয়ে হাটার সময় বুক কাঁপতো দুরুদুরু। হালের নাদুস নুদুস গরুগুলোর নিজ দেহের ভার বইতেই দম যায় আসে, মুখে লালা ঝরে; পা তুলে লাথি ছুঁড়বে কিভাবে!

চারণ ভূমিতে ছেড়ে দিয়ে গরু পালনের সেই আদিম পদ্ধতি আজকাল বিলুপ্ত প্রায়। গবাদিপশু মোটাতাজা করা বর্তমানে বেশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। খামারের পশুদের জন্য আয়োজন করা হয় পাঁচ তারকা মানের সুযোগ সুবিধা।মাথার উপর বৈদ্যুতিক পাখা, পায়ের নিচে ঢালাই মেঝে, দিনে দুইবার গা ডলে গোসল আর চব্বিশ ঘন্টার জন্য নিয়োজিত সেবক।

এমনকি লেজ তুলে মশাও মারতে হয় না, রয়েছে মশারির ব্যবস্থা। খাবার দেওয়া হয় রুচি অনুযায়ী, ঘড়ির কাঁটা ধরে।খোলা মাঠের ঘাস-বিচুলি নয়, তালিকায় যুক্ত হয়েছে উচ্চ আমিষ, পরিমিত শর্করা কিছুটা স্নেহ জাতীয় প্রক্রিয়াজাত পশুখাদ্য। ঘাস যে একেবারেই নেই তা নয়।

উন্নত জাতের ঘাস চাষ হচ্ছে পশুকে খাওয়ানোর জন্য। সেই ঘাস খেতে গরুকে মাঠের রোদে চরে বেড়াতে হয় না। ঘাস কাটার যন্ত্রে কেটে, সুন্দর পরিচ্ছন্ন পেয়ালায় পরিবেশন করা হয় কচি ঘাস। ছোট ছোট টুকরো, তাই গেলার পর জাবর কাটতে আরাম।   

দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিবছর প্রায় আড়াই কোটি গবাদিপশু জবাই করা হয়। গত কুরবানী মৌসুমে (২০১৯) দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ্ গবাদিপশু জবাই হয়েছে। দেশের মোট বার্ষিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক! অন্য যেকোন পশুর চাইতে গরু এগিয়ে আছে কয়েকগুণ।

মোট দেশীয় পণ্য উৎপাদনের অন্তত ৮ শতাংশ আসে গবাদিপশু পালন শিল্প থেকে। এটি একটি শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় কর্মসংস্থান হচ্ছে লাখো মানুষের।কয়েকবছর আগেও কোরবানীর মৌসুমে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ গবাদি পশু আসতো পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ হতে। সম্প্রতি রফতানীকারী দেশের আইনগত বাধ্যবাধকতার রেশ ধরে এক লাখের নিচে নেমে এসেছে পশু আমদানী।

ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাত থেকে আট লাখ গবাদিপশুর খামার গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে। দেশীয় খামারিদের ঠোঁটে ফুটেছে সমৃদ্ধির হাসি। গবাদিপশু মোটাতাজা করার এই সম্ভাবনাময় শিল্পে বিনিয়োগ করছেন অনেক নতুন নতুন উদ্যোক্তা। মোট কৃষি উৎপাদনের ৩৫-৪০ শতাংশ পূরণ করা এই খাতে স্বাবলম্বী হওয়ার আশা জেগে উঠেছে বাংলাদেশের।

এসকল অর্জন আকৃষ্ট করেছে কিছু অসাধু অতি মুনাফা-লোভী মানুষকে। এরা নানান অসুদোপায় অবলম্বন করে পশু মোটাতাজা করে বাজারে বিক্রি করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পশু অসুস্থ অবস্থায় হাটে বিক্রি হয় যেটা কোরবানীর জন্য বিধিসম্মত নয়।

অনিরাপদ পদ্ধতিতে মোটাতাজা করা পশুর গোশত শুধু মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। এই পশুগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে ব্যার্থ হলে স্ট্রোক অথবা হার্ট এটাকে মারা যাচ্ছে হুটহাট। অল্পদিনে বেশি লাভের আশায় প্রলোভিত হয়ে লোকসান গুনছেন খামারিরা।

স্বাস্থ্যবর্ধক  অষুধ (স্টেরয়েড হরমোন, ইউরিয়া) খাইয়ে মোটাতাজা করা গরু আপাতদৃষ্টিতে স্বাস্থ্যবান মনে হয়। গরুর মুখ ফুলে উঠে এবং পুরো শরীরে থলথলে ভাব চলে আসে। প্রকৃতপক্ষে গরুর দেহে গোশত বাড়ে না। বাড়ে পানি এবং চর্বি।

অনিরাপদ পদ্ধতিতে মোটাতাজা করা গরুর গোশত খেয়ে মানুষের মধ্যে বাড়ছে জটিল রোগের প্রকোপ। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ বহুমূত্র এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন।

কিডনী সমস্যা এবং ক্যান্সার আক্রান্তের হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এইসব সমস্যার অন্তরালে এই বিষাক্ত গরুর গোশতের ভূমিকা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গরুর গোশতে রয়েছে মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পুষ্টি উপাদান। আমিষের অন্যতম উৎস তো বটেই, এছাড়াও গরুর গোশতে আছে ভিটামিন বি, ভিটামিন ডি, জিংক, ফসফরাস, সোডিয়াম এমনকি পটাশিয়াম। সুষম খাদ্য হিসেবে গরুর গোশতের তূলনা নেই।

  •         ভিটামিন ডি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং হাড়ের গঠনে সহায়তা করে। অথচ স্বাস্থ্যবর্ধক অষুধ প্রয়োগ করা গরুর গোশত খেলে আর্থাইটিস হয়ে হাড় ভেংগে যেতে পারে।
  •         আমাদের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন ভিটামিন বি। গরুর গোশতে আছে ভিটামিন বি সিক্স (Vitamin B6) এবং ভিটামিন বি টুয়েলভ (Vitamin B12)। অন্যদিকে, অনিরাপদ গরুর মাংস হতে পারে চোখে ছানীর কারন।
  •         গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যতালিকায় আমিষের প্রয়োজনীয়তা অসীম। গরুর গোশত হতে পারে প্রয়োজনীয় আমিষের নির্ভরযোগ্য উৎস। গর্ভের সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থ্যতা নিশ্চিত করতে চাইলে অনিরাপদ গোশত খাওয়া যাবে না কিছুতেই।
  •         মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যে কয়টি উপাদানের উপর নির্ভর করে জিংক তাদের মধ্যে অন্যতম। সাধারণ ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারের ঝুঁকি পর্যন্ত হ্রাস করে জিংক। ইউরিয়া খাইয়ে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ!
  •         এছাড়া আমাদের দেহের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন হয় ফসফরাস, সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের। অথচ অনিরাপদ গোশত হতে পারে নানাবিধ জানা অজানা রোগের উদ্দীপক।

মানবদেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ উৎস নষ্ট হচ্ছে অসাধু চক্রের হাতে। উপকারী খাবার হচ্ছে অপকারের কারন। কিছু মানুষের লোভের বলি হচ্ছে শত লক্ষ মানুষ!

স্বাভাবিক নিয়মে গরু মোটাতাজাকরণ হতে পারে এসব সমস্যার সমাধান। জৈবিক উপায়ে গরু মোটাতাজা করা হতে পারে খামারিদের জন্য নিশ্চিন্ত বিনিয়োগ। অনিরাপদ স্বাস্থ্যবর্ধক না খাওয়ালে থাকে না নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গরু বিক্রির তাড়া। তাই উপযুক্ত দাম পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা যায় অনায়াসে।

ইউরিয়া না খাওয়ানোয় গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে স্বাভাবিক। তাই অতিরিক্ত অষুধ পথ্যের খরচ হয় নগণ্য। পশু মৃত্যুহার কম হওয়ায় খামারিদের বিনিয়োগ থাকে নিরাপদ।

সঠিকভাবে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, সঠিক অনুপাতে দানাদার এবং রসালো খাবার খাইয়ে একটি গরুর বৃদ্ধি দৈনিক প্রায় এক কেজি বা তার বেশিও অর্জন করা সম্ভব। ধান, গম, ভুট্টা, ডাল প্রভৃতির মিশ্রণে তৈরী দানাদার খাবার খাওয়ানো যায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। বাকী ৪০ শতাংশ খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারে পানি, কাঁচা ঘাস, খড়, ভুষিসহ অন্যান্য তরল এবং অর্ধতরল খাবার।

খামারের সুস্থ্য পরিবেশ বজায় রাখতে পারলে টীকা দেওয়া ছাড়া অন্য অষুধ পথ্যের খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। দৈনন্দিন খরচ থাকে নাগালের মধ্যে, তদুপরি গরুর স্বাস্থ্যবৃদ্ধি হয় আশানূরুপ।ভালো জাতের একটি বাছুর সঠিকভাবে বছরখানেক লালন পালন করলে বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে।

বর্তমানে ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, তাই সুস্থ্য সবল চঞ্চল গরুর দাম পাওয়া যায় অনিরাপদ উপায়ে মোটা করা ঝিমানো গরুর চাইতে বেশি।সৎ এবং নিষ্ঠাবান খামারিদের সহায়তাকল্পে প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মসূচী চলমান। উন্নত জাতের দ্রুত বর্ধনশীল জাত আনা হচ্ছে উন্নত দেশগুলো থেকে। বীজ এনে গবেষনার মাধ্যমে অধিক সহনশীল জাত উন্নয়নের কাজ চলছে সমানতালে।

আমদানী নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথচলার এই চেষ্টার অংশীদার হতে হবে আমাদের সকলকে।আমরা আমাদের মায়েদের জন্য, অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ্যতা নিশ্চিত করতে চাই। দৈনিক আমিষের চাহিদা মেটানোর প্রত্যয়ে কাউকে যেন অসুস্থ্যতা বরন করতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চাই।

নিরাপদ খামার গড়ে তুলতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে। নিরাপদভাবে পালিত গরু বিক্রয় এবং বিপণনের বাঁধাগুলো ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। পাইকারী এবং খুচরো পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যারা গোশত বিপণন এবং বিক্রয় নিয়ে কাজ করে। খাস ফুড এদের মধ্যে অন্যতম।

আগ্রহী উদ্যোক্তাগণ চাইলেই খাসফুডের ফ্র্যাঞ্চাইজি, ডিলার অথবা এজেন্ট হিসাবে নাম লেখাতে পারেন নিরাপদ খাদ্যের এই আন্দোলনে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করতে পারেন 01676162871 এই নাম্বারে।খাস ফুড খামার থেকে গোশত সংগ্রহ করে সরাসরি ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয় তাই খামারীরা তাদের শ্রমের সর্বোচ্চ মূল্য পান।

অন্যদিকে ক্রেতা পান ঘরে বসেই ন্যায্যমূল্যে নিরাপদ পণ্য। এই দুইয়ের সসম্মিলনে সুস্থ্য সুন্দর আগামী গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে খাস ফুড। সীমিত পরিসরে প্রক্রিয়াজাত হালাল গোশত রফতানী শুরু হয়েছে। আশাব্যঞ্জক হারে বাড়ছে রফতানী চাহিদা এবং পরিসর।

সম্মিলিত চেষ্টায় ঘরে ঘরে গরু পালনের সেই পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন না।আমাদের গ্রামগুলোয় অভাব যেন নিত্যসংগী। দিনে এনে দিনে খাওয়া এই মানুষগুলো হাড়ভাংগা পরিশ্রমের মূল্য পায় কড়ি আনায়।

গ্রামাঞ্চলের এই সৎ পরিশ্রমী জনশক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে পশুপালন খামার হয়ে উঠতে পারে ক্রেতা চাহিদা এবং বিনিয়োগ নিরাপত্তার ধারক। ৬৮ হাজার গ্রাম হয়ে উঠতে পারে ৬৮ হাজার সফল খামারের গল্প। প্রয়োজন সৎ সাহসী উদ্যোগ আর পরিশ্রম করার উদ্দ্যম!

Related Posts

Leave a Reply