‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসে বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমাদান মাস পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।
রমাদান এর প্রবেশদ্বার, শাবানঃ
হিজরি বর্ষের মাসগুলোর মধ্যে শাবান মাস সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহ অনেক ক্ষেত্রেই থাকে উদাসীন। অথচ রমাদানে প্রবেশের পূর্বের এই মাসের গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন নবী করিম (সা:) নিজেও। তিনি শাবান মাসকে তার নিজের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করিম সা. বলেন, । “রজব হলো আল্লাহর মাস। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর মাস রজবকে সম্মান করল, সে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আবার শাবান হলো আমার মাস। আর যে ব্যক্তি শাবান মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল সে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর রমজান মাস হলো আমার উম্মতের মাস।”
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজা রাখতে থাকতেন, যাতে আমরা বলতাম যে, তিনি (এ মাসে) আর রোজা ছাড়বেন না; আবার তিনি রোজা ভাঙ্গতে শুরু করতেন, যাতে আমরা বলতাম যে, তিনি (এ মাসে) আর রোজা রাখবেন না।” অপর বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ শাবানের পূর্ণ মাসই রোজা রাখতেন। তিনি শাবানের রোজা রাখতেন তবে অল্প কিছু দিন (রাখতেন না)।” (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকি, আবু দাউদ, মিশকাত)।
শাবান মাসে রমাদানের প্রস্তুতিঃ
সাহাবীদের রমাদানের প্রস্তুতি রজব মাসে শুরু হলেও তা আরও বেগবান হতো শাবানে। বিশেষ করে অর্ধ শাবান পার হওয়ার পর আসন্ন রমাদানের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে সিয়াম পালন, বেশি বেশি সালাত আদায় ও কোরআন তেলাওয়াত সহ নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতেন তারা। তাদের আদর্শে আদর্শিত হয়ে মুসলিম উম্মাহ এর কর্তব্য এই শাবান মাসকে যথাযত ভাবে কাজে লাগানো। শাবান মাসের শেষের দিকে রমাদানে প্রস্তুতি যেমন হওয়া উচিৎ –
১। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকা –
আসন্ন রমাদানে যেনো আল্লাহ তা’আলা সুস্থভাবে প্রবেশ করার তৌফিক দান করেন তা নিয়ে অপেক্ষায় থেকে নিজের মনকে প্রস্তুত করা। মুআল্লা ইবনুল ফদল (রহ.) বলেন, পূর্বসূরি আলেমরা ছয় মাস রমজান লাভের দোয়া করতেন এবং ছয় মাস তা কবুলের দোয়া করতেন।
২। অধিক পরিমাণে দো’আ করা –
রমাদানের জন্য বেশি বেশি দো’আ করাও মুমিনের জন্য আবশ্যক। নবী কারিম (সাঃ) নিজেও রমাদান লাভের জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট ফরিয়াদ জানাতেন।
৩। বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়া –
শাবান মাসেই আসন্ন রমাদানের বিধি নিষেধ সম্পর্কে সঠিক ভাবে জেনে সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করাও একজন মুমিনের দায়িত্ব। এতে করে রমাদান মাসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা আবশ্যক।
৪। নফল ইবাদাতে মনোনিবেশ করা –
আসন্ন সিয়ামের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে বেশি বেশি নফল ইবাদাতের প্রতি মনোনিবেশ করা আবশ্যক। তাই শাবানের শেষ সময়ে নফল রোজা, যিকির ও সালাতের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।
৫। রমাদানের পরিকল্পনা গ্রহণ –
রমাদানের প্রতিটি দিন কীভাবে অতিবাহিত করা হবে তা নিয়ে শাবান মাসেই সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। কোরআন তেলাওয়াত, নফল ইবাদাত, যিকির ও ক্ষমা প্রার্থ্যনার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তী হওয়ার এই সুযোগকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগাতে রমাদানের শুরুতেই প্রতিটি কাজের জন্য সময় ভাগ করে নিজেকে প্রস্তুত করা উচিৎ।
রমাদান এর পরিকল্পনাঃ
অনেকেই ভেবে থাকেন যে সালাত ও সিয়াম পালনের মাধ্যমেই তো রমাদান অতিবাহিত হয়, এর জন্য আবার আলাদা করে প্ল্যানিং এর প্রয়োজনীয়তা কোথায়। কিন্তু আদতে রমাদানের জন্যেও দরকার বিশেষ প্রস্তুতি। এই মাস রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস যা বছরে মাত্র একবারই আসে। আর এ সময়ই মুসলিম উম্মাহ পায় আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের ও নিজের গোনাহ মাফের সুযোগ। তাই সালাত ও সিয়াম পালনের পাশাপাশি কীভাবে এই মাসকে সর্বোচ্চ উপযোগী করে তোলা যায় তা পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা দরকার।
১। সময় বিভাজন –
রমাদানে একেক জনের কাজের সময় একেক রকম থাকে। তাই নিজের সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কখন কোন ধরনের আমল, যিকির করবেন তা ভাগ করে ফেলা উত্তম। একই সাথে কোরআন তিলাওয়াতের জন্য দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় আলাদা করে রাখা দরকার।
২। পরবর্তী দিনের কাজের তালিকা তৈরি –
রমাদানের প্রতিটি দিনের কাজে ভিন্নতা দেখা দেয়। তাই আগেরদিনই আপনার পরের দিনের কাজের তালিকা বা টু ডু লিস্ট তৈরি করে রাখার অভ্যাস করুন। এতে করে পরবর্তী দিনের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে।
৩। সেহরি ও ইফতারের মেনু প্ল্যানিং –
যেহেতু পুরো রমাদান জুড়ে খাদ্য গ্রহণের সময় এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে তাই পরিবাদের সদস্যদের বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে মেনু প্ল্যান করা এবং সেই অনুযায়ী বাজার করে ফেলা আবশ্যক। এতে করে রমাদান জুড়ে সুস্থতা বজায় থাকে এবং সিয়াম পালন সহজ হয়ে উঠে। আর এজন্য সেহরি ও ইফতারে নিরাপদ খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৪। চেকলিস্ট তৈরি –
রমাদানের জন্য প্রাত্যাহিক আমল ও যিকিরের বাইরে সেসকল আমল ও যিকির করতে আগ্রহী সেসব নিয়ে একটা চেকলিস্ট তৈরির চেষ্টা করুন। এর ফলে প্রতি বেলায় চেকলিস্ট মার্ক করার মাধ্যমে নিজের অগ্রগতি অনুধাবন করা সম্ভব। এই পদ্ধতির অনুসরণ করলে তা ইবাদাতে আরও মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দেয়।
৫। কোরআন ট্র্যাকার –
প্রতিদিন কত পারা বা কত পৃষ্ঠা বা আয়াত কোরআন পড়া হয়েছে তা ট্র্যাক করে রাখলে কোরআন পড়ার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং তা বেগবান হয়।
শাবান মাসকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে রমাদানে প্রবেশ করা মুসলিম উম্মাহ এর জন্য বেশ বড় ব্যাপার। এর ফলে রমাদান মাসকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। তাই রমাদানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলে চাইলে এখন থেকেই সচেষ্ট হওয়া আবশ্যক।