মধু নিয়ে মধুর আলাপঃ
নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় একটি লোককে ঘিরে আছে এলাকাবাসী। মাঝখানে দাড়ানো লোকটি নিজেকে মৌয়াল বলে দাবী করছে। সামনে রাখা মৌচাক, আর মধু। মৌমাছিও ভনভন করছে।মৌয়াল লোকটি চ্যালেঞ্জ দিলো যদি কেউ তার মধু ভেজাল প্রমাণ করতে পারে তবে তার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার।
তিনি নিজেও টেস্ট করে দেখাচ্ছেন। “এই যে দেখুন, পানিতে মিশছে না। এই যে দেখুন মধুতে আগুন জ্বলছে। এই যে দেখুন নখের উপর থেকে আর নড়ছে না।”
এলাকার বৃদ্ধরা মাথা নাড়াচ্ছে। “হা, এটাই আসল মধু। সবাই কিনতে পারেন।”
বেচারা মৌয়ালের কথা শুনে অনেকেই মধু কিনা শুরু করেছে। বৈজ্ঞানিক ভাবে এই টেস্ট গুলো কতটুকু যৌক্তিক? নাকি এটা শুধুই প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত একটি কুসংস্কার? কিংবা মধু আসলেই কেনো খাওয়া উচিৎ? শুধু কি শীতকালেই খেতে হবে? অথবা খাঁটি মধু চিনবো কিভাবে?
চলুন। এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজার জার্নিতে যাই। [passster password=”123456″]
আসল নাকি নকল?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো কোন সহজলভ্য পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি যার মাধ্যমে বলা যাবে কোনটা আসল আর কোনটা নকল মধু। খালি চোখে আন্দাজ করাটা দুষ্কর। তবে কেবলমাত্র অভিজ্ঞ মধুখাদকরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন।
১। নকল মধু একই রকম রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। সাধারণত চিনি, পটাশ, এলাম, হানি এসেন্স, চা পাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়।
২। নকল মধু সব মৌসুমে সারা বছর প্রায় একই ঘ্রাণ, একই রং ও একই স্বাদের হয়।
৩। মধু হল দামী এবং খুব চাহিদা সম্পন্ন পণ্য। কোণ এলাকায় মৌচাক হতে মধু সংগ্রহ হলে ঐ এলাকার গ্রাহকরাই তা চড়া দামে কিনে নেয়, বাইরে এনে বিক্রয় করার মত অবশিষ্ট থাকে না।
৪। ভাল মধুর সাথে নকল মধু মিশিয়ে যে এডালটারেটেড মধু বিক্রয় হয় তা ধরতে পারাটা বেশ কষ্ট সাধ্য ব্যাপার।
৫। বৈজ্ঞানিক পরিক্ষার মাধ্যমে কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
মধু | pH | Conductivity us/Cm |
T.D.S mg/L |
Brix | Sucrose | Color |
লিচু + চিনির সিরা | 4.46 | 989 | 495 | 83.1 | 7.36 | 1658 |
মধু | pH | Conductivity us/Cm |
T.D.S mg/L |
Brix | Sucrose | Color |
সরিষা + চিনির সিরা | … | … | … | … | 38.75 | … |
৬। এডাল্টারেটেড মধুর সুক্রোজের মান পাঁচের অধিক হলে, তাতে চিনি মেশানো হয়েছে ধারণা করা যেতে পারে।
৭। নকল মধুতে পোলেনের উপস্থিতি পাওয়া যায় না।
বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুনঃ
https://www.facebook.com/khaasfood/photos/a.840398386045856/1421652704587085/?type=3&theater
https://www.facebook.com/khaasfood/photos/a.840398386045856/1272093582876332/?type=3&theater
https://www.facebook.com/khaasfood/photos/a.840398386045856/1514948821924139/?type=3&theater
https://www.facebook.com/khaasfood/photos/a.840398386045856/1275586535860370/?type=3&theater
এবার আমাদের মৌয়াল ভাইর দিকে আসি। তিনি যে টেস্ট গুলো করেছেন তা কতটুকু যৌক্তিক?
বোল ভরতি মৌমাছি ও মৌচাক নিয়ে ফেরি করা মধু বিশুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মৌমাছির গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়ার কারণে এবং কিছু বাচ্চা মৌমাছি এমনিতেই চাকের সাথে লেপ্টে থাকে, উড়ে যেতে পারে না। এই টাটকা চাক, লালচে মধু ও জীবন্ত মৌমাছি দেখে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
উদম গায়ে ধোঁয়া উঠা আঁটিসহ ফেরিওয়ালা এইমাত্র মধু কেটে এনেছে এরূপ অভিনয় করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত।
ফুটপাতে মধু বিক্রেতাদের সহজ- সরল অভিব্যাক্তির অভিনয় এবং সরলমনা মহিলাদেরকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করা হয়।
[বাংলাদেশে পদ্ম ফুল হতে মধু সংগ্রহের তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি।]
এবার বুঝছেন তো?? কিভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকেও ভুলভাল বুঝিয়ে বিক্রি করে যেতো?
এই পরীক্ষাগুলো কেন সঠিক নয়?
১। মধুর আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.৩৬, তাই এটি পানিতে ঢাললে নিচে গিয়ে জমা হয়। অনুরুপ ঘন চিনির সিরা পানিতে ঢাললে সটান নিচে চলে যাবে। বিদেশে মধুতে ময়েশ্চার কমিয়ে রাখা হয়। পানিতে ঢাললে সোজা নিচে গিয়ে জমা হয়। যে সমস্ত দেশীয় মধু যেমন সুন্দরবনের মধুতে ময়েশ্চার বেশি থাকে।পানিতে ঢাললে ভেঙ্গে ছড়িয়ে পরে তলানিতে পৌছায়। আসলে মধু পানিতে ঢেলে পরীক্ষাটি বিভ্রান্তিকর।
২। নকল মধু এবং আসল মধু উভয়ই আগুনে জ্বলে।
৩। নখের উপর ঘন সিরা রাখলে তা গড়িয়ে পরবেনা। কিন্তু অনেক সময় আসল মধুতে জলীয় অংশ বেশি থাকলে তা গড়িয়ে পরে যাবে।
৪। কুকুর বা পিঁপড়ে দিয়ে মধু পরীক্ষা করা যায় না।
৫। আমাদের দেশে পদ্মফুল হতে মধু সংগ্রহ করার প্রচলন নেই।
৬। আম ফুল হতে ব্যাপকভাবে মধু উৎপাদন হয় না।
আরো জানতে চান? কেবল ক্লিক করুনঃ
https://blog.khaasfood.com/authentic-honey/
https://blog.khaasfood.com/organic-honey/
মধু চেনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি!
একক কোণ পরীক্ষার সাহায্যে মধুর বিশুদ্ধতা নির্ণয় করা বেশ দুরূহ একটা ব্যাপার। তবে অনেকে অভিজ্ঞতার কারণে স্বাদ ও ঘ্রাণ দেখে মধুর পিউরিটি বুঝতে পারেন।
সুক্রোজ পরীক্ষাঃ বিশুদ্ধ মধুতে সুক্রোজের পরিমাণ পাঁচের অধিক হয় না।
পোলেন টেস্টঃ মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে মধুতে পোলেনের উপস্থিতি দেখে মধুর বিশুদ্ধতা অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়। এর পরিমাণ ২৫০০০ পিচ/গ্রাম মিনিমাম। পোলেন টেস্টের মাধ্যমে মধুটি কোন ঋতুতে এবং কোন ফুল হতে সংগ্রহ করা হয়েছে তা নির্ণয় করা যায়।
ময়েশ্চার পরীক্ষাঃ রিফ্রেক্টোমিটারের সাহায্যে মধুতে জলীয় অংশের শতকরা হার নির্ণয় করা যায়। এই শতকরা হারের তারতম্য হতে মধুর বিশুদ্ধতার ধারণা নেয়া যেতে পারে। যেমন- সরিষা ফুলের মধুতে জলীয় অংশের পরিমাণ ১৯- ২১, লিচু ফুলে ২০- ২২, সুন্দরবনের মধুতে ২৪- ২৭ থাকে।
HMF (Hydroxy Methyl Furfural): মধুতে সরাসরি তাপ দিলে এর ফ্রুক্টোজ ভেঙ্গে HMF তৈরি হয়। HMF হল Silent Enemy, এর পরিমাণ মধুতে বৃদ্ধি পেলে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক হয়। উন্নত বিশ্বে এর মান নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ মিলিগ্রাম/কেজি ম্যাক্সিমাম। ইউ.ভি এসপ্রেক্টোফমিটার দিয়ে পটাশিয়াম ফেরো সায়ানাইট, সোডিয়াম বাই সালফাইট, জিঙ্ক এসিটেট এর সাহায্যে মান বের করা যায়। তবে মধু অনেকদিন রেখে দিলেও HMF বাড়ে। তাপ দিলে HMF দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
সাধারণ মানুষরা কি আন্দাজে মধু কিনবেন?
প্যাঁচাল তো অনেক হলো বৈজ্ঞানিকভাবে কিভাবে আসল মধু চিনবেন সেটা নিয়ে। কিন্তু আমরা যারা নিয়মিত মধু খাই, তাদের বাসায় তো আর ল্যাব নেই। তারা কিভাবে খাঁটি মধু কিনে খাবো? সব সমস্যারই সমাধান আছে। এই যেমন সাধারণ মানুষদের জন্যও রয়েছে তিনটি সমাধান। যার মাধ্যমে আপনি নিশ্চিতভাবে খাঁটি মধু পেতে পারেন।
১. নিজেই মধু চাষ করা। সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মধু চাষের নিয়মবিধি জেনে নিয়ে নিজেই মাঠে নেমে যান। এতে পাবেন শতভাগ মধু খাঁটি হওয়ার নিশ্চয়তা।
২. যেহেতু অনেকের পক্ষেই নিজের মধু চাষ করা সম্ভব না, তাই যারা মধু চাষ করে তাদের কাছে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। দেখেও এলেন কিভাবে তারা চাষ করে আবার কিনেও আনলেন। রথ দেখতে গিয়ে কলা বেঁচাও হয়ে গেলো।
৩. উপরের দুটি সম্ভব না?? নো টেনশন। আপনার জন্য বেশ কিছু দূরদর্শী মানুষ খাঁটি মধু নিয়ে এসে আপনার হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়ার কাজ করছে। আপনার কাজ হচ্ছে এরকম বিশ্বস্ত একটা কোম্পানি থেকে মধু সংগ্রহ করা। যার উপর আপনার আস্থা রয়েছে।
সাধারণ মানুষের জন্য মধু চেনার সহজ উপায় হল যার থেকে মধু নেয়া হবে উনার বছরব্যাপি সংগ্রহীত মধু যদি বৈচিত্র্যময় হয়, ভিন্ন রং, ভিন্ন ঘনত্ব ও ব্যাতিক্রমি স্বাদের হয়। তবে অনুমান করা যায় উনি খাঁটি মধু বিক্রয় করছেন।
মধু নিয়ে মিষ্টি কথার পাশাপাশি তিক্ত সত্য গুলো জানা উচিৎ। কারণ মধুর এত এত উপকারিতা থাকতেও কোন কাজে আসবে না যদি না খাঁটি মধু খেতে পারেন।
মধু নিয়ে উপরোক্ত সাতকাহন পাঠিয়ে দিতে পারেন আপনার পরিচিতদের কাছেও। তাঁরাও যেন সচেতন হয়ে বিশুদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা আপনারও দায়িত্ব। আপনি যেটা জানেন সেটা অন্যদেরকেও জানিয়ে দিতে বলেছেন নবী করীম (সঃ)। সুতরাং শেয়ার করুন আপনার শুভানুধ্যায়ীদের কাছেও। [/passster]